মেয়েটাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম আমাদের এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান স্লোগানের এক আলোচনা সভায়। খুব সাদামাটা ছিলো সাজসজ্জা এবং চেহারা। আমি মেয়েটার বাম পাশ করে দাঁড়িয়ে থেকে শেষ বারের মতো কথাগুলো মিনমিন করে বলছিলাম। একটু সরতে যেয়েই আচমকা ওড়নাটা চেয়ারের পেরেকে বেঁধে গেলো। খেয়াল না করে টান দিতেই পরপর করে ছিঁড়ে গেলো আমার শখের জামদানি থান দিয়ে তৈরি করা লেহেঙ্গা টার ওড়না। এই প্রথম কোনো প্রোগামে উপস্থাপনার দায়িত্ব পেলাম, তাই এতোটা উচ্ছ্বাস। উচ্ছ্বাসের পরিমাণ এতোটাই বেশি যে উপস্থাপনার প্রস্তুতির থেকে আমার সাজগোজের প্রস্তুতিটাই বেশি ছিলো। আর সেই উপস্থাপনার আগেই কিনা এই দশা!! এখন আমি কি করবো,কি করে স্টেজে যাবো ভেবে যখন প্রায় কেঁদেই দিবো তখন প্রথম দেখেছিলাম মেয়েটিকে।
সবুজ টাইপের একটা গামছা প্রিন্টের শাড়ি। ঠিক সবুজ ও না, আবার সবুজ। রং টা নিদিষ্ট কি রঙের বুঝে উঠতে উঠতেই বুঝলাম এটা কিছুটা বাঁধাকপির ভিতরের অংশটার রঙের মতো। তাহলে কি নাম এই রঙ টার? সবুজ তো বটেই তবে কোন শেডের সবুজ এটা? এটাকে যদি বাঁধাকপির মতো সবুজ বলি হাস্যকর হবেনা? আমি মেয়ে হয়ে কিনা রঙ চিনিনা!!
এই ইভেন্টের পরিচিত এক আপুনিকে ডেকেই ভ্যাঁ করে দিলাম,আমার ওড়নাটা ছিঁড়ে গেছে,আমি এখন কিভাবে উপস্থাপনা করবো বলে। আপুনি কিছুটা বিরক্তই হলো,কারণ আপুনি আর একটা কাজে ব্যস্ত ছিলো। আমি করুণ চোখে এদিক ওদিক পিটপিট করে তাকাচ্ছিলাম। দেখলাম সেই মেয়েটা একটা মুচকি হাসি দিয়ে এগিয়ে আসলো আমার দিকে। আমি কি বলবো!! হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে।মেয়েটা কাছে এসে বললো,
>>আমি হেল্প করি আপনাকে?
মেয়েটার দুইহাতে দুটা দুটা করে কাঁচের গাঢ় সবুজ চুরি আর কপালে একটা ছোট্ট লাল টিপ।মেয়েটার কান খালি। কোনো ম্যাচিং এই কিছু পড়েনি,তবুও অপরিপূর্ণতা ছিলোনা চেহারায় ।
আমি বললাম হুমম করো আপুনি।
আমার এই একটা বদ অভ্যাস। বলা নেই,কওয়া নেই,জানা নেই,শোনা নেই ধাপ করে সামনের মানুষ টাকে তুমি করে বলি। পরে যখন জানতে পারি সামনের মানুষটা আমার বড় তখন খুব বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এইবার ও তুমি করে বলার পরে ভয়ে ছিলাম।
আচ্ছা তুমি এই অবস্থাতেও সাজো? প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেওয়ার পর আরো অসস্তি হতে লাগলো। কিযে বলে এখন!! মনে কি কষ্টই পেলো।।
মেয়েটা আমার সাথে ওয়াশরুমে এসে ওড়নাটা ঠিক শাড়ির আঁচলের মতো করে পড়িয়ে দিয়েই চলে গেলো। ও যাওয়ার পরে মনে হলো বেয়াদবি হয়ে গেছে। আমি ধন্যবাদ পর্যন্ত জানায়নি ওকে। নিজেকে বেশ করে বকে দিয়ে ঘুরেঘুরে দেখলাম ওড়নার ছেঁড়া অংশটুকু দেখা যায় কিনা।
না দেখা যাচ্ছেনা। বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে করতে বেমালুম ভুলেই গেলাম মেয়েটার কথা। এসিডদগ্ধ ভার্সিটি পড়ুয়া এক ছাত্রীর সংগ্রামের কিছু কথা সবার সামনে তুলে ধরার জন্য একটা ফুটেজ চালু করা হলো প্রজেক্টেরে।
মেয়েটা আর কেউ না,আমার ওড়না ঠিক করে দেওয়া সেই মেয়েটি!!
আমি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলাম প্রজেক্টেরের দিকে। মেয়েটার কথার স্বর ভেসে আসছে স্পিকার থেকে।
“আমি মেয়ে,আমি মানুষ। আমারো আছে অনেক অবাধ স্বপ্ন। আমিও স্বপ্ন দেখি নিজের স্বপ্নের রাজপুত্র কে নিয়ে,স্বপ্ন দেখি নিজের সংসারের, স্বপ্ন দেখি একটা চাকরির যেটা আমার প্রাপ্য। যার জন্য আমি গ্রাম থেকে এই শহরে এসেছি পড়াশুনার জন্য। আমি এবার মাস্টার্স পরীক্ষার্থী। আর কিছুদিন,তারপরেই ছেড়ে যাবো নিজের প্রিয় ক্যাম্পাস,প্রিয় মুখগুলোকে। যুদ্ধরত হবো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধে। হয়তো একটু একটু করে পূরণ করবো আমার বাবার আয়েশী ইচ্ছাগুলোকে। পূরণ করবো মায়ের খুব যতনে লুকিয়ে রাখা অনেকদিনের একজোড়া স্বর্ণের বালার স্বপ্নকে। পূরণ করবো ছোট ভাইটার কতোদিনের স্বপ্ন
একটা বাইসাইকেলের।
একটা ছোট্ট ঘর বানাবো, যেখানে থাকবো আমার পরিবার নিয়ে। যেখানে স্বপ্ন গুলো অবাধ হলেও অবাধ্য হবেনা আমার পৃথিবীতে। যেই ঘরে জোনাকির ন্যায় ছোট্ট হয়েও সুখ গুলো সযতনে জ্বলতে থাকবে।
এবার বাস্তবে ফিরি,এগুলো আমার স্বপ্ন। তাই বলে কি স্বপ্নই থাকবে? শুধু এজন্য যে,আমি এসিডদগ্ধ? আমার চেহারার একাংশ ঝলসে গেছে কারো ছুঁড়ে দেওয়া এসিডে এজন্য? অন্যায় তো কিছু করিনি। ভালোবেসেছিলাম শুধু। জানতাম না,তার একটা কথার বিরোধীতায় আমি ঝলসে যাবো। তবে কোনো অভিযোগ নেই তার প্রতি,এই পুরুষ শাসিত সমাজের প্রতি,অথবা এই জীবনের প্রতি। বরং বলা চলে আমি কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি। তারা আমাকে নতুন একটা জীবন দিয়েছে,নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে,আর শিখিয়েছে জীবনের অর্থ।
হয়তো স্বপ্নের রাজপুত্র আসবেনা আমার হাত ধরতে। তাই বলে কি আমি থেমে যাবো,স্বপ্ন দেখা থামিয়ে দিবো? না,মোটেও না । শুধু বিয়ে,সংসার ই জীবন হতে পারেনা। আমি আরো দশটা মেয়ের আশা হতে চাই,আমি আমার বাবা মার লাঠি হতে চাই,আমি এই সমাজকে কিছু দিতে চাই। আমি আমার স্বপ্নগুলো নিয়ে বাঁচতে চাই।
এসিডদগ্ধ হওয়া মানেই জীবনের শেষ নয়। বরং ফিনিক্স পাখির মতো শেষ থেকে নতুন করে জন্ম নেওয়া। ”
সবাই দাঁড়িয়ে করতালি দিতে লাগলো। আমি অবাক আর বিমোহিত হয়ে খুঁজতে লাগলাম সেই মেয়েকে।
কিছুক্ষণ পরে মেয়েটা স্টেজে আসলো। তাকে অনুরোধ করা হলো কিছু বলার জন্য।
আমাকে একজন প্রশ্ন করেছে আজ আমি এই অবস্থাতেও সাজি? তাকে বলতে চাই, হ্যাঁ আমি সাজি। কেন সাজবোনা? আমি মনে করি আমি যথেষ্ট সুন্দর। এসিড আমার বাইরের সৌন্দর্য্যকে হয়তো নষ্ট করে দিয়েছে,কিন্তু আমার ভিতরকে ছুঁতেও পারিনি। আমি সাজি কারণ আমি সাজতে পছন্দ করি,সেটা আমার চেহারা হোক কিংবা আমার জীবন। ”
এবার আমি দাঁড়ালাম,এবং মাথা টা একটু ঝুকিয়ে জোরে জোরে করতালি দিতে
শুরু করলাম।।
২০টি মন্তব্য
মিজভী বাপ্পা
লেখাটি পড়ে খুব ভালো লাগল। ধন্যবাদ।
ইয়াগনিন সুলতানা
ভালো লাগাতে পেরে আমি সার্থক
কৃষ্ণমানব
আরো তো কিছু লেখে থেকে যায় ।
মনে হচ্ছিল, নিজের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্য ।।
কল্পনার পটভূমিটা ভালোই ।
লেখাটা পড়লেই বুঝা যায় , নারীরাও চাইলে তাদের স্বপ্নগুলো খোলা আকাশে মেলে ধরতে পারে ।
প্রয়োজনীয় সাপোর্ট পারে , ভালো পর্যায়ে পৌছতে ।।।
সম্পূর্ণ লেখাটা পড়ে ,
ছেলেবেলায় একটা গান এর কথা মনে পড়ে গেলো !!
মিনা-রাজুর,,শুনে থাকতে পারেন ,,
‘ আমি বাবা মায়ের শত আদরের মেয়ে ‘…
ইয়াগনিন সুলতানা
হুমম শুনেছি,গান টা অনেক প্রেরণা দেয়।
আর এমন টা হওয়ার জন্য হয়তো আমরা ও জড়িত কোথাও না কোথাও
মেঘাচ্ছন্ন মেঘকুমারী
এসিড সন্ত্রাস বন্ধ হোক। সম্মিলিত প্রতিরোধ করতেই হবে। আর এসবে ক্ষতিগ্রস্থদের কোন দোষ নেই, একথা ভেবে তাঁদেরকে আমাদের সাথে মিলেমিশে থাকার মন মানষিকতা তৈরী করতে হবে। ভালো লেগেছে আপনার লেখা।
ইয়াগনিন সুলতানা
ঠিক বলেছেন।
ধন্যবাদ
নাটোর শূন্য কিলোমিটার
এসিড এর বিরুদ্ধে কাজ করছি , আমার একটা ইউনিট নাটোরে এখন কাজ করে যাচ্ছে । ভালো লিখেছেন ।
ইয়াগনিন সুলতানা
ভালো উ
নুসরাত মৌরিন
“আমি সাজি কারণ আমি সাজতে পছন্দ করি,সেটা আমার চেহারা হোক কিংবা আমার জীবন। ”
অসাধারন লাগলো…।জীবনের গল্প,সব তুচ্ছ করে বেঁচে থাকার গল্প। বাবা মার হাতের লাঠি কিংবা সমাজের আলো হওয়ার গল্প। এমন গল্প আরো চাই…।
শুভকামনা রইলো…। 🙂
ইয়াগনিন সুলতানা
ধন্যবা্দ।অবশ্যই চেষ্টা করবো
খেয়ালী মেয়ে
অনেক ভাল লাগলো পড়ে-
ইয়াগনিন সুলতানা
ধন্যবাদ
ব্লগার সজীব
এত ভালো এবং গুরুত্বপুর্ন টপিকস এর উপরে আরো লেখা প্রয়োজন। আপনার লেখাটি ভালো হয়েছে। এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা আনতেই হবে। আপনি ভালো লেখেন। মাঝে মাঝে হারিয়ে যান আপনি। ভালো লেখা থেকে আমাদের বঞ্চিত করা কি উচিৎ ?
ইয়াগনিন সুলতানা
অনেক ধন্যবাদ।
এটা ঠিক আমি প্রায়ই হাওয়া হয়ে যায়
ছাইরাছ হেলাল
হয,আপনি ঠিকই বলেছেন বাইরের সৌন্দর্য্যকে হয়তো নষ্ট করা সহজ ভেররের সৌন্দর্য্য নয়। এয়ার এ ভাবনা থেকেই
তাঁরা এগিয়ে যাবে ,দাঁড়াবে মাথা উঁচু করে।
আপনার নিয়মিত লেখা চাই।
ইয়াগনিন সুলতানা
অবশ্যই চেষ্টা করবো আলসেমি না করে নিয়মিত হওয়ার
লীলাবতী
ভালো লিখেছেন আপু। ধন্যবাদ শেয়ারের জন্য।
ইয়াগনিন সুলতানা
অনেক অনেক ধন্যবাদ
কৃন্তনিকা
লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো… (y)
এধরনের লেখাকে সাধুবাদ জানাই…
ইয়াগনিন সুলতানা
🙂 ধন্যবাদ