আমিনার স্বপ্ন
সেদিন ছিল পদ্মা ব্রিজ উদ্ভোদনের দিন। সারা রাত জেগে সে দেখছিল টেলিভিশনে মানুষের আনন্দ আর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন। কখন যেন সে ঘুমিয়ে পড়ে।
সে চলে যাচ্ছে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের দিকে কুয়াকাটায় । কত যে নদী পার হতে হল ফেরি করে। কোন ব্রিজ নাই। কীর্তিনাশা, সুগন্ধা, আরিয়ালখাঁ, সিকারপুর, দপদপিয়া, পায়রা, লাউখালি, আন্ধারমানিক, সোনাতলা আর মহিপুর।
প্রথমে যেতে হবে শরিয়তপুর। সেখানে কয়েকদিন থাকতে হবে। যতোই দক্ষিণে যায় ততোই নদী খাল আর স্রোতা। সরু সরু নাম না থাকা খাল। স্থানীয়রা এদের ‘পদ্মার শাখা’ বলে। সেখানে আবার জোয়ার ভাটাও খেলা করে। উঁচু রাস্তার দুই ধারে বিশাল স্থান জুড়ে শুধু পানি আর পানি । এই জায়গা গুলোতে কোন ফসল হয় না ।দশ মাস পানির তলায় থাকে ।
বাড়ি গুলো স্যাঁতস্যাঁতে । সবার একটা করে নৌকা। এই নৌকায় একমাত্র যানবাহন এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়ার জন্য।
নদী গুলো বেশ চওড়া । এখানকার অধিবাসী এই নব্য পলি মাটি দ্বারা গড়া স্থানে এই ভাবেই বসবাস করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে । নদী ভাঙ্গন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস আর দক্ষিণে ‘ ইন্ডিয়ান ওস্যান’ থেকে বয়ে আসা সাইক্লোন তাদের নিত্য সঙ্গী।
আমিনা স্বপ্ন দেখতে থাকে কিভাবে এদের জীবন মান উন্নত করা যায়। পানির জায়গাতে পানি থাক। এই পানি নিয়েই এদের থাকতে হবে। হিমালয় থেকে নেমে আসা নদী গুলোকে তো তার পানি গড়িয়ে নিতে হবে সমুদ্রে ঢালার জন্য।
স্যাঁতস্যাঁতে অথবা পানিতে ডুবে থাকা স্থানে কি ভাবে বাড়ি করা যায়ঃ
প্রথম ছবিঃ ভাসমান বাড়ি , দ্বিতীয় ছবিঃ জমে থাকা পানির উপরে পিলারের উপরে বাড়ি
উঁচু উঁচু পিলার দিয়ে তার উপরে বাড়ি করা যা স্যাঁতস্যাঁতে এবং অস্বাস্থ্যকর অবস্থা থেকে রক্ষা করবে।
অথবা পানিতে ডুবে থাকা স্থান গুলোতে ভাসমান বাড়ি বানানো । যতদিন পানি থাকুক না কেন নিজেরা থাকতে পারবে নিরাপদে।
আমিনার স্বপ্নে সেই স্থানের বাড়ি গুলি এই টেকনোলজি ব্যাবহার করে গড়ে উঠেছে।
চাষবাস, ডেইরী ফার্ম আর পোল্ট্রি ফার্ম
চীনের ভাসমান ধান চাষ
ভাসমান চাষবাস এই ডুবে থাকা বিল, জলা আর হাওড় এলাকার জন্য সুন্দর এক সমাধান। ক্রমাগত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এর সমাধান বের করেছে উন্নত দেশগুলো তাদের টেকনোলোজি দ্বারা। শুধু চাষবাস নয় গরুর খামার, পোলট্রি, সব কিছুই করা যায় ভাসমান পদ্ধতিতে। শুধু তাই নয় মানুষ জন শিখে গেছে মিঠা পানির গলদা চিংড়ী চাষ, কাঁকড়া চাষ আর কুইচ্যা মাছের চাষ । সব গুলোই রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আনা যায়। সে স্বপ্নে দ্যাখে এখানকার মানুষ তাই করছে।
ভারটিক্যাল পদ্ধতিতে চাষবাস
১) ভারটিকাল পদ্ধতিতে সাইলেজ ২) ভারটিকাল পদ্ধতিতে নিপিয়ার ঘাস চাষ
ডুবে থাকা স্থান গুলোতে গরুর ঘাস মাটিতে না করে ভাসমান প্লাটফর্মে ভারটিক্যাল পদ্ধতিতে করা যাবে। যাতে অল্প যায়গাতে অনেক ঘাস আর সাইলেজ বানানো যাবে।
আমাদের দেশে অনেক মানুষের নিজস্ব যায়গা নাই যেখানে ফসল উৎপাদোন করতে পারে। ভারটিক্যাল পদ্ধতি হল এর সমাধান। আমিনা স্বপ্নে দেখছে এখান কার মানুষ সেই আধুনিক টেকনোলজি ব্যাবহার করছে ।
চারা থেকে ফসল উঠা, সময় দরকার তিন মাস । তবে নুতুন টেকনোলোজি ব্যাবহার করে এই সময় কমিয়ে দুই মাস করার টেকনোলোজিঃ
বীজ থেকে অঙ্কুর করা এবং অঙ্কুর থেকে চারা গজাতে এবং তা হ্যান্ডেল করতে সময় দরকার এক মাস। এই সময় টা আলাদা ভাবে করে নিয়ে ( ট্রের মাধ্যমে ) তা চলমান ইলেকট্রিক বেল্টের মাধ্যমে ভেসে থাকা প্লাটফর্মে ঢেলে দিয়ে চাষ বাস করলে ফসল রেডি হতে তখন সময় লাগবে আর মাত্র দু মাস। এই পদ্ধতিতে বছরে ছয়টি ফসল করা যাবে। মাটিতেও করা যাবে একই পদ্ধতি অনুসরণ করে।
নদীমাতৃক আমাদের এই দেশে নদী কেন্দ্রিক পর্যটনের এক বিরাট সম্ভাবনার নামঃ
দারিদ্র ঘোচানো, বেকারত্ব দূরীকরণ, বৈদেশিক মুদ্রা কামানোর এক বিরাট সম্ভাবনার নাম পর্যটন । আজকের পৃথিবীতে পর্যটন শিল্প এক বিরাট ভূমিকা রাখছে একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে। আমিনা স্বপ্ন দেখছে সারা দেশে তো বটেই বিশেষ করে দক্ষিণে এর সম্ভাবনা নিয়ে। কারন এখানে আছে পদ্মা ,মেঘনা, আর যমুনার মিলন স্থান। যা দেখতে সমুদ্রের মতো। মাঝে আছে বেশ কয়েকটি চর। এই চর আর মিলন স্থানটিকে নিয়ে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে।
তা ছাড়া সুন্দরবন, জেগে উঠা হাজার খানেক চর, ভাসমান বাজার , পদ্মবিল, নদী তে ক্রুজ এবং সমুদ্রে ক্রুজ ।
পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু হিমালয় পর্বত মালা থেকে নেমে আসা শত শত নদী নেমে এসে গোড়ে তুলেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বদ্বীপ । আর সবচেয়ে বড়ো এই বদ্বীপে কি ভাবে তা প্রকৃতি তে প্রভাব ফেলেছে সেটা দেখতে হলে এখানে আসতে হবে। যেমন পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এই খানেই সৃষ্টি হয়েছে ।
অনেক অনেক আগে সাভারের নিচেই ছিল সমুদ্র। নদী থেকে বয়ে আনা পলি জমে জমে ভরাট হতে থাকে । সমুদ্র সরে গিয়ে মুন্সিগঞ্জের দক্ষিণেই একসময়ই ছিল। রাজা লক্ষণ সেনের রাজধানী এক সময় পদ্মার উত্তরে ছিল পদ্মা উত্তরে চলে আসে । রাজধানী পদ্মার দক্ষিণে চলে যায়। এই হল নদীর খেলা।
এই ব্যাপারটিকে ব্র্যান্ড করে দরকার প্রচার প্রচালনার মাধ্যমে। মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি যা পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টি হওয়ার দেশ। সেই বৃষ্টি সৃষ্টি করেছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বিরাট মিঠা পানির হাওড়।তাতে জন্ম নিয়েছে পানিতে জন্ম হওয়া জঙ্গল , এটাকেও ব্র্যান্ড করা যায় ।’রাতার গুল’ ব্র্যান্ড করার মত আর একটা বন । আমিনা স্বপ্নে দেখছে মানুষ তা করা আরম্ভ করে দিয়েছে।
জঙ্গল ভিত্তিক পর্যটনঃ
বাংলাদেশে আছে চার ধরনের ফরেস্ট।
১) সিলেটের রেইন ফরেস্ট, ২) পার্বত্য চট্টগ্রামের চির হরিত বন ৩) মধুপুর,দিনাজপুরে এবং ভাওয়ালের পাতা ঝরা শালবন ৪) আর আছে বিখ্যাত সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট।
আমিনা স্বপ্ন দেখছে পর্যটন কে প্রমোট করতে মানুষ কি চিন্তা ভাবনা করতে পারে । মানুষ জঙ্গল এর নীরবতা, এর গাছ গাছালির বৈচিত্র্য, পশু পাখী দেখতে চায়। এটাকে কাজে লাগিয়ে কত দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। আমিনা স্বপ্ন দেখা শুরু করে।
১) ট্রি টপ ওয়াক ওয়ে ২) জীপ লাইন ৩) জঙ্গলের উপর দিয়ে ক্যাবেল কার ও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সেগ ওয়ের ব্যাবস্থা, ৪) ক্যাবেল কার , যেখান থেকে নিচের প্রকৃতি দেখা যাবে, ৫) অনেক উঁচু থেকে দোলনা ৬) বার্ড ওয়াচ , ট্রেকিং , মাছ ধরা, ৭) কম্যুইনিটি হলিডে অর্থাৎ কৃষক ,জেলে পরিবারের সাথে থেকে তাদের জীবন আর কালচার অবজার্ভ করা। যা বিদেশী টুরিস্ট দের বিশেষ আকর্ষণের ব্যাপার।
ফলের বাগান ট্যুর, চর ট্যুর, রিভার ক্রুজ , আইল্যান্ড হপিং, ফোক ড্যান্স এর ব্যাবস্থা, গ্রাম্য মেলা দেখার ব্যাবস্থা।
রিসোর্ট হবে একটু অন্যরকম
জঙ্গলের মধ্যে রিসোর্ট, ট্রি টপ রিসোর্ট, জঙ্গল ভিউ রিসোর্ট, রিভার ভিউ রিসোর্ট, ভাসমান রিসোর্ট মালদ্বীপের মতো।
হটাৎ আমিনার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠে সে ভাবলো আর যাহোক পদ্মা ব্রিজ হয়ে গেছে তার সাথে অন্য সব নদীতে ব্রিজ হয়ে গেছে। আর ফেরি পার হতে হবেনা।
মানুষও উঠে পড়ে লেগে গেছে কিভাবে পর্যটন বাড়ানো যায় তাই নিয়ে ।
এখন দরকার মার্কেটিং করা, প্রমোট করা আর নিরাপত্তার ব্যাবস্থা করা।
কৃষির ক্ষেত্রে অনেক টেকনোলোজি এখনো অনেক দরকার।
নেদারল্যান্ড এর ভাসমান গরুর ফার্ম
দেশে হাজার হাজার খামারি গোড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ১.৪ মিলিওন ডেইরি ফার্ম আছে।তার মধ্যে ৭০% , ১-৩ টি গরু নিয়ে ছোটো ফার্ম।
মেয়েরাও বেশ অবদান রাখছে । নারী খামারি হয়েছে অনেক , গরু মোটা তাজাকরন করে গ্রামের নারীরা এগিয়ে আসছে কৃষিতে। শরৎ চন্দ্রের ‘ মহেশ’ এর মতো হাড় জির জিরে গরু আর হয়না । মানুষ জেনে গেছে কি ভাবে মোটা তাজা করতে হয়। হয়তো আমিনার অন্যান্য স্বপ্নও একদিন বাস্তবে রূপ নেবে। সেই আশায় সে রইলো।
ফটো ক্রেডিটঃ উইকিপেডিয়া
একটি স্বপ্নঃ হুসনুন নাহার নার্গিস, লন্ডন
১৫টি মন্তব্য
সাবিনা ইয়াসমিন
আমিনার স্বপ্নগুলো কেবল গল্পে না থাকুক, বাস্তব হয়ে আসুক বাংলার লাখো-কোটি মানুষের কাছে। ফুল-পাখি ছেড়ে নতুন দিগন্ত নিয়ে স্বপ্ন দেখা আমিনাদের হাত ধরেই পরিবর্তন আসবে নদীমাতৃক বদ্বীপে। বহিবিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়নকে বাস্তবিক করতে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা অত্যাবশক।
একটা অংশ পড়ে হতবাক হয়েছি। এই লেখাটি না পড়লে এই বিষয়টা হয়তো কখনও আমার জানা হতো না। সাভারের নিচে সমুদ্র ছিলো!
অনেক ধন্যবাদ আপু গল্পের মধ্যে এত তথ্যাদি এবং ব্যবস্থাপনার যথাযথ দিক তুলে ধরার জন্য।
শুভ কামনা 🌹🌹
নার্গিস রশিদ
অনেক ধন্যবাদ সাবিনা তোমার সুন্দর মতামতের জন্য। শুভ কামনা।
বোরহানুল ইসলাম লিটন
অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা
টেকনোলজি দিয়ে চলেছে পদে পদে আস্থা।
সুন্দর অনুভবে অতি চমৎকার সৃজন।
আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানবেন সতত।
নার্গিস রশিদ
ঠিক বলেছেন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য। শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমি কৃষি ভালোবাসি, গ্রামে পরে আছি এ কারনেই। লোকজন বেশ অবাক হয় আমার কাজে। কেন আমি এসব করি? টাটকা দুধের চা, ফরমালিন ছাড়া সবজি কিন্তু মজার।
কৃষিতে প্রযুক্তির বড় অভাব। ফার্ম করার ডাক্তার নেই, পশু ডাক্তার। আমার কালীকে বিক্রি করতে হলো ডাক্তারের অভাবে।
আর ভাসমান যে প্রজেক্ট দেখলাম এগুলোর জন্য শিক্ষিত জনবলের পাশাপাশি সরকারী সহযোগিতা দরকার। হবে হয়তো কোন একদিন আমরা আশাবাদী। কৃষি আর পর্যটনে সম্ভাবনাময় একটি দেশ আমাদের।।।
নার্গিস রশিদ
একেবারে খাটি কথা। ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এইসব বিষয়ের উপর । দরকার প্রচুর পরিমাণে ভ্যাটেনারী ডাক্তারের । গুটিকয়েক বই মুখস্ত করে ছাত্র জীবন শেষ করার ব্যাপারটা আর চলবে না। নুতুন প্রযুক্তির ব্যাবহারিক দিকটায় নজর দিতে হবে। অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
ছাইরাছ হেলাল
আমরা স্বপ্ন দেখতে পারছি এটিও অনেক অনেক প্রাপ্তি।
এভাবেই হয়ত একদিন ভাবনারা সত্যি হয়ে বাস্তবে ধরা দেবে, সে অপেক্ষায়।
নার্গিস রশিদ
সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ । শুভ কামনা।
সৌবর্ণ বাঁধন
অনেক তথ্যবহুল লিখনী। সাবলীল ভংগিতে বলা বর্ণনায় কতো কিছু জানা হলো। আর আগামী ভবিষ্যৎ এর স্বপ্ন ও উকি দিল। শুভেচ্ছা।
নার্গিস রশিদ
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য। নিশ্চয় আমাদের দেশের তরুণ তরুণীরা উদ্বুদ্ধ হবে। সে প্রত্যাশা থাকবে সবসময়। শুভ কামনা।
নার্গিস রশিদ
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য । নিশ্চয় আমাদের দেশের তরুণ তরুণীরা উদ্বুদ্ধ হবে। সে প্রত্যাশা থাকবে সবসময়। অনেক শুভ কামনা।
নিতাই বাবু
তথ্যবহুল লেখনী! অনেককিছু জানা হলো।
অনেক অনেক শ্রদ্ধা ও শুভকামনা থাকলো।
নার্গিস রশিদ
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য। শুভ কামনা।
হালিমা আক্তার
আমেনার স্বপ্ন বাস্তবে প্রতিফলিত হোক এই কামনা করি। আপনার প্রতিটি লেখাই তথ্য বহুল। অনেক কিছু জানা হলো। শুভ কামনা অবিরাম।
নার্গিস রশিদ
আমাদের দেশের তরুণ /তরুণীরা অনুপ্রাণিত হক আর এগিয়ে আসুক এই কামনা করি। অনেক ধন্যবাদ আর শুভ কামনা।