আমার ভালবাসা
পর্ব ৩
.
আমার ভালবাসারা রোজ রোজ আমার সাথে আরো নিবিড় বন্ধনে বাঁধা পড়ছে।যতই দিন যাচ্ছে আমার সাথে তাদের সখ্যতা ততই বাড়ছে। রোজ বিকেলে নিয়ম করে ছাদে উঠি, ওদের শরীর স্বাস্থ্য দেখাশোনা করি। প্রিন্স প্রিন্সেসদের কোলে নেই,রেলিঙে বসিয়ে আদর করি।এভাবেই কেটে যায় পুরো বিকেল। দিনের বেলা ওরা মাঝে মাঝে আমার বাসার সিঁড়ি গেটের মুখে এসে আমাকে ডাকে।তখন তাদের ডাক শুনে আমি বুঝে যাই ওরা কিছু চাইছে।নিচে নেমে তালা খুলে আমি তাদেরকে নিয়ে আসি,খাবার দেই,পানি দেই। কখনো কাশি হলে ওষুধ দেই, তারপর তারা সেরেও ওঠে। কখনো প্রিন্স আমাকে দেখলেই কোলে ওঠার বায়না করে।তার বায়নার ধরনটা হল এরকম, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়বে,মাথা নুইয়ে দিয়ে কুককুক কুক করতে থাকবে। এর মানে হল,
“আমি হেঁটে কিংবা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারব না,আমাকে কোলে নাও।”
আর প্রিন্সেস আমাকে দেখলেই বসে যাবে,যদি তার কোলে উঠতে মন চায়। ছোট প্রিন্সেস টা খুব দূরন্ত ছটফটে,সে কোলে উঠতে চায় না।বরং নাচানাচি, লাফালাফিতে তার বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু কৌশলে তাকে একবার ধরে ফেললে তখন সে খুব শান্ত। সে আবার রুটি খেতে খুব পছন্দ করে।তাই আমি বাড়ি ফেরার পথে পাউরুটি কিনে আনি।পাউরুটির লোভ দেখিয়ে ছোটটাকে কোলে নেই। অতপর তিনজনে মিলে কাড়াকাড়ি করে আমার হাত থেকে রুটি খায়।
এরা রোজ বিকেলে বাড়ি ফেরে বলে এদেরকে রেখে আমরা বেশিক্ষণের জন্য কোথাও যেতে পারি না, গেলেও বিকেলের আগে ফিরে আসতে হয়। তো একদিন একটা জরুরী সংবাদ পেয়ে আমরা পুরো পরিবার গ্রামের বাড়ি চলে গেলাম। নিচতলার ভাড়াটিয়া ছেলেদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হল বিকেল বেলা যেন তারা তালা খুলে প্রিন্স বাহিনীকে ভেতরে ঢুকায়।কিন্তু তাদের হাতে দায়িত্ব দেয়ার পরও আমি নিশ্চিত হতে পারলাম না। আমার মনে নানা আশঙ্কা ভর করতে লাগল। কখনো মনে হচ্ছে ওদের বিড়ালে খেয়ে নেবে,কখনো মনে হচ্ছে কেউ ধরে নিয়ে যাবে।আরো কত কী! সেই টেনসানে গ্রাম থেকে যতদ্রুত সম্ভব বাসায় ফেরার পথ ধরলাম। এরা ফেরে মূলত বিকেল চারটার পর। পাঁচটার দিকেও যদি আমরা পৌঁছতে পারি তাতেও কাজ হবে,অর্থাৎ প্রিন্সদের ঠিকমতই ঘরে ফেরানো যাবে। পথে বাস খুব দ্রুত চলল, মাঝপথে থামিয়ে যাত্রী তোলেনি, রাস্তাও বেশ ভাল। কিন্তু সমস্যাটা হল ময়মনসিংহ পৌঁছার পর। পুরোটা পথ শুধু জ্যাম আর জ্যাম। যেখানে সর্বোচ্চ আধা ঘন্টার পথ বাসস্টপ থেকে বাসা, সেখানে লাগল দেড় ঘন্টা।আমার দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে যাচ্ছিল ওদের জন্য। অটো থেকে নেমে দ্রুত হেঁটে আমি সোজা বাসায় ফিরে এলাম, বাসার অন্যরা অটো থেকে নেমে অন্য আত্নীয়দের সাথে গল্প করে ধীর পায়ে হেঁটে ফিরছিল, কিন্তু এতটুকু বিলম্ব আমার সহ্য হয় নি। আমার কাছে একটা চাবি ছিল, সেটা দিয়ে তালা খুলে সবার আগে আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম,তারপর সোজা সিঁড়িকোঠায় গেলাম,যেখানে ওদের থাকার জায়গা। গিয়েই আমার আত্না প্রায় খাঁচাছাড়া! প্রন্সেসরা দুটিতে ঘুমোচ্ছে কিন্তু প্রিন্স কোথায়? প্রিন্স নেই, কোথাও নেই,সিঁড়িতে নেই,বারান্দায় নেই। পেছনের বাউন্ডারী ঘেরা খালি জায়গাটুকুতে নেই, দেয়ালের ফাঁক ফোকরে নেই, পুরো রাস্তা জুড়ে খোঁজা হল, আমার প্রিন্স কোথাও নেই।আমার ভেতরটা কেমন মরুভূমি হয়ে গেল,খাঁ খাঁ করতে লাগল। দোতলা থেকে কতবার করে নামি, এখানে খুঁজি,সেখানে খুঁজি, না, আমার প্রিন্স সোনা কোথাও নেই। প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল সেই ছেলেগুলোর ওপর যারা ঠিকভাবে ওদের ভেতরে রাখতে পারেনি। একেকবার একেকটা আশঙ্কা হচ্ছিল। কখনো মনে হচ্ছিল এই বুঝি কেউ তাকে ধরে নিয়ে গেল, এতক্ষনে হয়ত তার গলাটা রক্তে লাল হয়ে গেছে! আহা, কত কষ্টই না পাচ্ছে আমার প্রিন্স। কখনো মনে হচ্ছিল কোন চোর হয়ত প্রিন্সকে দড়ি বেঁধে আটকে রেখেছে, তার পায়ে যন্ত্রণা করছে।
আল্লাহর কাছে একমনে প্রার্থনা করতে থাকলাম,তিনি যেন প্রিন্সকে ফিরিয়ে দেন।মনে মনে জানতাম সেটা অসম্ভব, তবু ভাবতাম অাল্লাহ চাইলে কত অসম্ভব কে সম্ভব করতে পারেন। একমনে প্রার্থনা করতে করতে একটু ঘুমালাম। তবে সে রাতে তেমন ভাল ঘুমুতে পারিনি,কারণ রাতে না খেয়ে শুয়েছিলাম,মাথাও প্রচন্ড ব্যাথা করছিল।তাছাড়া ভাত আমার গলা দিয়ে নামছিল না। তো সে রাতে একটু পরপর ঘুম ভাঙছিল।কোথায় যেন পেয়েছিলাম মাঝরাতে অাল্লাহ কে ডাকলে তিনি শুনেন বেশি।যতবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল ততবার প্রার্থনা করছিলাম। অবশেষে শেষরাতে মনে হচ্ছিল, কাকতালীয়ভাবে যদি এখন আমার প্রিন্স ডেকে ওঠে, যদি তার কুক্কুরুক কুক আওয়াজটা আবার শুনতে পাই……
.
এমন সময় সকল অসম্ভব কে সম্ভব করে সেই আওয়াজ ভেসে এল কুক্কুরুক কু…..ক….!
আমি নিজের কানকে প্রথমে বিশ্বাস করাতে পারিনি। তারপর গায়ে চিমটি কেটে দেখি, নাহ এটাই সত্য! প্রিন্স আশেপাশেই কোথাও আছে।জানালা দিয়ে তাকালাম,দেখি অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না,তবে বোঝা যাচ্ছে সে এখানেই কোথাও আছে। সাথে সাথে বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। তিনি বললেন, এটা নাকি অন্য বাড়ির মোরগ ডাকছে। আমি দৃঢ়তার সাথে বললাম এটাই আমার প্রিন্স। কারণ আমি যে তার প্রতিটা আওয়াজকে খুব ভালভাবে চিনি।তারপর তাকে আবিষ্কার করা হল বাউন্ডারীর ভেতর আম গাছের ডালে! অচেনা লোক দেখে সে হয়ত বাসায় না ঢুকে আমগাছের ডালে আশ্রয় নিয়েছে। তাছাড়াও আমি ছিলাম না বলে “অায় আয়…..” বলে কেউতো ডাকেনি।তাই হয়ত সে একাজ করেছে। এবার তাকে কাঠি, লাঠি সহ আরো নানা কিছু দিয়ে খোঁচাখুচি করার পরো সে গাছ থেকে নামছে না। বেচারার অনেক তীব্র ঘুম,ধাক্কা দিলেও ভাঙে না। ঘুমের ঘোরেই কুক্কুরুক কুক করছে। অতপর মোটা বাঁশ এনে সজোরে ধাক্কা দেবার পর সে উড়ে এসে ঘাসের ওপর বসল। অন্ধকারের মধ্যে ঘুমঘোরে সে কাওকেই চিনতে পারছিল না, ফলে আমি কাছে যেতেই সে পালাতে চাইল। কিন্তু যখন আমি তাকে কোলে তুলে নিলাম,দুটো কথা বললাম তখনি সে বুঝে গেল আমি কে। তারপর আর নামার চেষ্টা করল না।
তবে অবাক করা ব্যপার হল, সন্ধ্যারাতে যখন তাকে খুঁজেছি,তখন গাছের ডালেও দেখেছি। আমি আর আমার বাবা দুজনেই দেখেছি,প্রিন্স তখন গাছের ডালে ছিল না। তারপর শেষরাতে সে কোথা থেকে কি করে ফিরে এল তা মহান সৃষ্টিকর্তাই জানেন। মাঝে মাঝে মনে হয় এটা আমার আর্তনাদের ফলাফল,যা আমি তাঁর দরবারে জানিয়েছিলাম।
যা হোক, তাকে ফিরে পেয়ে আমি যেমন আনন্দে আত্নহারা,সেও তার ব্যতিক্রম নয়।সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আমি বলছিলাম,
“তুই এত দুষ্ট কেন প্রিন্স? গাছের ডালে চড়ে ঘুমিয়ে গেলি? বাহিরে কত ঠান্ডা,তোর গা ভিজে গেছে।”
আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রিন্স উত্তর দিল,
“হু……”
“তোর যে আগে একবার জ্বর হয়েছিল মনে নেই?”
“হু…”
“আর কখনো এমন করবি?”
উত্তর নাই।
হয়ত এ উত্তরটা বলার মত সামর্থ্য তার নেই।
(চলবে)
২৩টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
বাহ কথাও বলে দেখছি!
আপনার প্রিন্স খুব কিউট। 🙂
নীরা সাদীয়া
ghjh ওরা দেখতে এবং আচরণে সত্যিই খুব কিউট ছিল। এদের কোন তুলনা হয়না আপি।
ধন্যবাদ। শুভসন্ধ্যা।
নীলাঞ্জনা নীলা
ছিলো? মানে এখন…
নীরা সাদীয়া
এখন নেই। শেষপর্বে আমন্ত্রন রইল। ওটা দেয়া হয়েছে। ওটা পড়লেই বিস্তারিত জানতে পারবেন।
শুভরাত আপি।
ছাইরাছ হেলাল
আপনি যে মায়া মমতায় এদের আলগে রাখছেন তাতে আপনার অসম্ভব মায়াময়তা প্রকাশ পাচ্ছে,
আবার মনে কু ডাক ও দিচ্ছে,
এত্ত ভালোবাসা সইবে তো,
এরা যেন আপনার হয়েই অনন্তকাল বেঁচে থাকে এ কামনা করি।
নীরা সাদীয়া
সত্যি, ভালবাসারা অল্পদিনেই হারিয়ে যায়। বেশি ভালবাসা সয় না কপালে।
ধন্যবাদ। শুভসন্ধ্যা।
মোঃ মজিবর রহমান
মায়া মমতায় তাঁদের কথা বলতেও শিখিয়েছেন।
চমৎকার।
নীরা সাদীয়া
কিভাবে যেন কথা বলা মানে শুধু মাত্র “হু” এটুকু বলা শিখে গেছিল। জানি না কিকরে শিখল।
ধন্যবাদ। শুভসন্ধ্যা।
অরণ্য
সুন্দর গল্প। আপনার উপস্থাপন সুন্দর। (y)
নীরা সাদীয়া
ধন্যবাদ। শুভসন্ধ্যা।
মেহেরী তাজ
প্রিন্স দেখি আপনার প্রশ্নের জবাব ও দেয়! আমার ছোট বোন বলে ওর বিড়াল নাকি ওর সাথে কথা বলে। জিজ্ঞেস করি কি কথা বলে সে নাকি সব প্রশ্নের জবাবে মিয়াও বলে, আর জবাব দিতে ইচ্ছে না করলে চুপ থাকে। আপনার প্রিন্স ও দেখি তেমনই!
চলুক মন্দ কি? আছি আছি!
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ পাশে থাকার জন্য। আপনি ঠিকি বলেছেন। ওরা আমাদের কথার বুঝতে পারে এবং উত্তর দেয়। কিন্তু আমরাই তাদেরটা আসলে বুঝিনা।
শুভকামনা এবং শুভরাত।
ইঞ্জা
হু, বাহ দারুণ তো, মুরগিও হু বলে। 😀
নীরা সাদীয়া
hjk যখন প্রথমদিন হু বলল আমিও বেশ অবাক হলাম। তারপর থেকে মাঝে মাঝে বলত, তখন আর অবাক লাগত না।
শুভকামনা রইল।পরের পর্বে আমন্ত্রণ জানাই।
প্রহেলিকা
দুজনের কথোপকথন শেষ না করেই বলে দিলেন চলবে?? ভালোই লাগছিলো পড়তে। সাবলীল প্রকাশভঙ্গী।
নীরা সাদীয়া
vbh সেদিনের মত কথোপকথন ওখানেই শেষ ছিল।
ধন্যবাদ আপনাকে পাশে থাকার জন্য।
শুভকামনা রইল।পরের পর্বে আমন্ত্রণ জানাই।
শুন্য শুন্যালয়
জড়তামুক্ত সাবলীল লেখা তোমার। এই প্রিন্স প্রিন্সেস তো আমাদের সোনেলা পরিবারের অংশ হয়ে যাচ্ছে। 🙂 দেখেছিলাম প্রিন্স হারিয়ে যাবার পর কীরকম অস্থির হয়ে গিয়েছিলে তুমি। হুম বলে মোরগ, হাও সুইট। প্রতিদিনের গল্প হয়ে উঠুক ওরা। অপেক্ষায় ..
নীরা সাদীয়া
ওরা ছিল আমার পরিবারেরও অংশ। আমার সঙ্গী, আনন্দ দানের নিখাঁদ নির্ভেজাল উৎস।
শুভকামনা রইল।পরের পর্বে আমন্ত্রণ জানাই।
ব্লগার সজীব
আপনার মায়া মমতা দেখে তো অবাক হয়ে গিয়েছি আপু। প্রতিটি পর্ব পড়ে এই পর্বে মন্তব্য করলাম। মায়া যে কোন কিছুর বর্ষিত হলে সেটা ভিজে যাবেই। পরের পর্বের অপেক্ষা করছি।
নীরা সাদীয়া
hh ঠিক বলেছেন।মায়া যে কোন কিছুর ওপর পড়লে তাতো ভিজে যাবেই।
অনেক ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল।পরের পর্বে আমন্ত্রণ জানাই।
নীহারিকা জান্নাত
দম বন্ধ করা একটি পর্ব!
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ।পরবর্তী পর্বে নিমন্ত্রণ রইল।
নীরা সাদীয়া
সকলকে নতুন তথা শেষ পর্বে আমন্ত্রণ রইল।
শুভকামনা রইল সকলের তরে।