২০১০ এ স্বামী যখন ফেসবুক একাউন্টটি খুলে দেন, তখন এখনকার মত এতো বন্ধু ছিলনা। অনেকদিন ব্যাবহারও হয়নি। অতঃপর যখন টুকটাক ফেসবুক দেখা শুরু করি, তখন একজন বন্ধু হলো। নিখাদ বন্ধুত্ব। হঠাৎ হঠাৎ ম্যাসেজ দেয়___ ও কবি, আমাকে নিয়া একখান কবিতা লেখো না… দোস্ত, কই হারাইয়া যাও… আমার জন্মদিন গেলো, উইশ করলা না…
সে তাঁর বাবার একমাত্র পুত্র সন্তান। তাঁর নিজেরও ছোট দুটি ছেলে-মেয়ে আছে। মা-বাবা, স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে সুন্দর একটি পারিবারিক গল্প হতে পারতো। হয়নি। আমি বলি, তোমার বউকে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে এড করে দিও। তাহলে আমাদের তিনজনের বন্ধুত্বটা আরও সুন্দর হবে। জানলাম, তাদের জটিল সমস্যার কথা। তাঁর তালাকপ্রাপ্তা বোনটি সন্তানসহ তাদের পরিবারেই থাকে। বউ আর বোনের দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। সেই পরিস্থিতিতে তাঁর মা সবসময়ই নিজের কন্যা’র পক্ষাবলম্বন করে থাকে। এতে বউটি রাগ করে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাবার বাড়ি চলে যায় একাকী। বাচ্চারা বাবার তত্ত্বাবধানে স্কুলে যাতায়াত করে, খায় দায় ঘুমায়। বউ কিছুতেই ফিরবে না যতক্ষণ না আলাদা বাসা নিচ্ছে।
আমার বন্ধুটি পরে বিপাকে। না পারছে মা, বোন’কে কিছু বলতে। না পারছে বউকে বোঝাতে। এমন এক অসহায় অবস্থা ! আমি চুপ থাকি। উৎসাহব্যঞ্জক অবিরত প্রশ্ন করি না। শুধু বলি পাশাপাশি বাসা নিলেও তো পারো। বাবা-মা’কেও দেখা হল… বউও কাছে থাকলো। কিন্তু আমার বন্ধুর ভাষ্য __ বাবা হার্টের রুগী… কখন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরে… আমি ছাড়া তো বাড়িতে আর কোন পুরুষ নেই। সেই সময় তাকে খুব বিষণ্ণ, অসহায় মনে হল। অতঃপর অনেকদিন পর হঠাৎ একদিন ম্যাসেজ দিলো__বন্ধু, শ্বশুরবাড়ি যাইতাসি বউ’কে আন্তে, দোয়া কইরো। এরপর তাঁর টাইমলাইনে তাদের যুগল ছবি… বাচ্চারা সহ তাদের স্বামী-স্ত্রী’র হাস্যোজ্বল ছবি… বাবা-মা সহ পুরো পরিবারের মন ছুঁয়ে যাওয়া সব ছবি দেখে মনটা ভালোলাগায় ভরে উঠে। লাইক দেই। শুভকামনা জানিয়ে কমেন্ট দেই। দেশে গেলে তাঁর পরিবারের সাথে একবেলা খাবারের নিমন্ত্রণ জানায় সে।
২০১২ তে মাত্র উনিশ দিনের জন্য দেশে যাই। সদ্য মাতৃহারা আমি মনখারাপ এবং সময় স্বল্পতার কারনে তাঁর নিমন্ত্রন রক্ষা করতে পারিনি। তবে, তাঁর বাসা আর আমার আত্মীয়ের বাসা কাছাকাছি হওয়ায় মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য দেখা করার সুযোগ হয়েছিলো। ব্যস্ততার কারনে এরপর আর কথা হয়নি খুব একটা। মাঝে মাঝে ম্যাসেজ দেয়___ও বন্ধু, কই হারাইলা… ২০১৪ তে আবার দেশে যাই যদিও, সময়গুলো ক্যামন দ্রুত শেষ হয়ে যায়__ কারো সাথেই তেমন যোগাযোগ করা হয়ে উঠে না।
আজ জানলাম, সে স্ট্রোক করে জাগতিক সকল চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে চলে গেছে। মিশে গেছে পৃথিবীর গহীন মৃত্তিকায়। ভেবেছিলাম কারো মৃত্যু নিয়ে আর লিখবো না। কিন্তু আজ অনেকটা সময় ইনবক্সে আমাদের কথোপকথন গুলো দেখলাম। তাঁর টাইমলাইন দেখলাম। আত্মীয়দের শোকগাঁথা লেখাগুলো পড়লাম। আমি কিছুই লিখলাম না সেখানে। লিখলাম আবারো কারো মৃত্যু নিয়ে। আমার টাইমলাইনে আমার বন্ধু আর ফলোআরদের জন্যে। কারন____
পারিবারিক জটিল মুহূর্তগুলোয় একজন পুরুষ কতটা অসহায় থাকে, কেউ কি কখনো ভাবে ? মাঝে শিশুরাই আমাদের বড়দের ভুলের মাশুল গুনে। দু’দিনের পৃথিবীতে সবাইকে নিয়ে সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকা যায় চাইলেই… একটু… শুধু একটু সেক্রিফাইস করলেই…
পরিবার নিয়ে ভাল থাকুন। শুভকামনা সকলকে…
৩৬টি মন্তব্য
অরণ্য
আজ আপনাকে যেভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে কাল যেন তা ভুলে যান, তাই যেন হয়। তা না হলে ঝামেলায় পড়ে যেতে পারে পৃথিবী!
রিমি রুম্মান
আমরা ভুলে যাই বলেই তো স্বাভাবিক নিয়মে আবার সামনে এগোই। কিছুই কি থেমে থাকে ?
শাহানা আফরিন স্বর্ণা
দোয়া করি যেন ইহকালের অসহায়ত্ব পরকালে শান্তি হয়ে দাড়ায়!
আসলেই একটু সেক্রিফাইস আমাদের কে কতই না ভাল রাখে। সময় থাকতে বুঝি উঠিনা আমরা !!!
রিমি রুম্মান
ঠিকই বলেছেন। সময় থাকতে আমরা বুঝে উঠি না কিছুই। ভাল থাকবেন।
বনলতা সেন
পারিবারিক যে সমস্যাটি প্রথমে তুলে ধরলেন তা চিরন্তন। কিন্তু এই সহজ সমাধান সব সময় হয় না।যা এখানে হয়েছে।
আপনার সাথে একমত ছাড় দিয়ে হলেও শিশুদের কথা আমাদের বেশি করেই ভাবতে হবে।
রিমি রুম্মান
এই ছাড়টা ই তো কেউ দিতে চায় না। ছাড় দিলে সবকিছুই অনেক সুন্দর হতো। ভাল থাকবেন।
জিসান শা ইকরাম
লেখাটি পড়ে খারাপ লাগছে খুব
অন লাইনে এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের বিষয়
একজন ভালো বন্ধু চলে যাওয়া অনেক কষ্টের।
আল্লাহ তাঁর আত্মাকে শান্তি দান করবেন অবশ্যই।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও। শুভকামনা সবসময়…
শুন্য শুন্যালয়
মনটা খারাপ হলো খুব। সংসারের জটিলতায় পুরুষরা আসলেই অসহায় হয়ে যায়। আপনার বন্ধুর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন পরিবারের সবাইকে নিয়ে।
স্বপ্ন নীলা
নীচের লাইন তিনটিতে মনটাকে ব্যাথায় নাড়িয়ে দিল
রিমি রুম্মান
তাঁর মৃত্যু বিবাদে লিপ্ত থাকা পরিবারকে নাড়া দিয়েছে কিনা জানিনা… ভালো থাকুক পরিবারটি। ভালো থাকুক অবুঝ শিশু দুটি ।
খেয়ালী মেয়ে
মৃত্যুই সত্য–আচমকা সামনে এসে দাঁড়ায় এই সত্য…আপনার বন্ধু যাতে নতুন ঐজগতে ভালো থাকে সেই দোয়ায় করি….
একটা সংসারে অনেকগুলো মানুষ একসাথে থাকতে গেলে একটু আধটু মনোমালিন্য হবেই, দুদিনের এই পৃথিবীতে সবার সাথে মানিয়ে চলার ধৈর্য্য শক্তি যেন উপরওয়ালা আমাদের সবাইকে দেয়…
রিমি রুম্মান
ভাল বলেছেন। ভাল থাকুন আপনি। শুভকামনা জানবেন।
ছাইরাছ হেলাল
একজন পুরুষ মানুষের অসহায়ত্ব আপনি যে ভাবে তুলে ধরেছেন এর থেকে ভাল করে আর বলা সম্ভব নয়।
সেক্রিফাইস সবাই করে না। শিশুরা বড়ই অসহায় আমরা তা ভুলে যাই।
সবাই যেন ভাল থাকে তা আমরাও চাই।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন পরিবার নিয়ে। শুভকামনা রইলো।
লীলাবতী
আপু লেখা পড়ে মন ভারী হয়ে গেলো।ভালো একজন বন্ধুর মৃত্যু হলে কষ্ট হয় খুব।আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসীব করুন।
রিমি রুম্মান
দোয়া করি আমিও তাঁর জন্যে। তাকে নিয়ে এমন করে লিখতে হবে কোনদিন ভাবিনি।
খসড়া
আপনার প্রায় লেখাতেই থাকে বিষন্নতার সুর। আসুন বিষন্নতা ঝেরে প্রান খুলে হাসি আর আনন্দে বাঁচি।
রিমি রুম্মান
প্রতিটি বিষাদময় ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে এক একটি শিক্ষা দিয়ে যায়। প্রতিটি লেখায় একটি মেসেজ থাকে। এর থেকে কারো কোন উপকার হয় কিনা জানিনা। তবে আমার হয়। আমি নতুন করে আর সংশোধন হই। ভাল থাবেন।
প্রহেলিকা
আপনার সেই বন্ধুটির আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। ভালো থাকুক তিনি যেখানেই থাকুক। মৃত্যু পথের পথিক আমরা সবাই।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন পরিবারের সকলকে নিয়ে। শুভকামনা জানবেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
একজন প্রকৃত বন্ধু চলে যাওয়া খুব বেদনার।মানুষ কত ধরনের জটিলতার সম্মুখীন হন,তা আসলে বাইরে থেকে ধারনা করা যায় না।ওনার আত্মা শান্ত লাভ করুক।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। ভাল থাকুন সবসময়।
স্মৃতির নদীগুলো এলোমেলো...
ভালো থাকুক সবাই। সেইসাথে উনিও, অন্য কোথাও
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুক তার ছোট্ট শিশু দুটি। ভাল থাকুক বৃদ্ধ বাবা মা। ভাল থাকুক প্রিয় স্ত্রী। তাঁর আত্মা শান্তি পাক।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
বন্ধু অনেকই হয়। কিন্তু বন্ধুত্ব সকলের সাথে গড়ে উঠেনা। তাঁর সাথেই বন্ধুত্ব জমে উঠে যার সাথে প্রাণ খুলে মনের কথা বলা যায়।
একজন ভালো বন্ধু হারিযে ফেলা অনেক কষ্টের।
দোয়া করি আপনার বন্ধুটি পরপারে ভালো থাকুক।
একটু স্যাক্রিফাইস করলে যদি সকলে মিলে ভালো থাকা যায়, তো মন্দ কি। আবার স্যাক্রিফাইস কিন্তু একতরফা হয়না। আপনার কথা থেকেই জানলাম, ছেলেটি নিজেই বলেছে কোন একটা বিরোধ বাঁধলে মা একতরফা তাঁর মেয়ের পক্ষ নিযে নেন। হয়তো এমন হয়েছে ন্যায়-নীতির তোয়াক্কা না করে একচোখা পক্ষাবলম্বনের কারনে বউটি চলে যায়।
যেহেতু তালাকপ্রাপ্তা বোনটিও ছিলো সংসারে সেহেতু পরিবারে মিউচ্যুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং বজায় রাখার মুল দায়িত্ব ছিলো মায়ের। কিন্তু মা তা মেনটেইন করতে পারেননি। আর সন্তান হিসাবে ছেলেটি পড়ে যায় অসহায় অবস্থায়।
বিয়ে পরবর্তী জীবনের দ্বীতিয ধাপে ছেলেরা পড়ে শাখেরকড়াতে। তাঁকে তখন উভয়দিক সামলাতে হয়। এক্ষেত্রে যে যতো দক্ষ, তার সংসার থাকে ততো ঝামেলাহীন।
রিমি রুম্মান
ঠিকই বলেছেন। আমার বন্ধুটি আসলে পরিবারের সবার প্রতিই বিরক্ত ছিল। মাকে তো আর কিছু বলা যায় না, তাই সে খুব আশা করতো বউটি অন্তত তাকে বুঝুক। আবার বউকেও দোষারূপ করতো না। সে আসলে এমন এক অসহায় অবস্থায় ছিল যে, শেষে মানসিক চাপে ব্লাড প্রেশার হাই হয়ে ব্রেন স্ট্রোক করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে ২৫ শে ডিসেম্বর। আমি জেনেছি একমাস পর ২৫ শে জানুয়ারি।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এমন পরিস্থিতি হলে ছেলেরা বেশি চাপে পড়ে, কারন অবুঝ বউকে দোষারুপ করা যায়, প্রয়োজনে শাসন বা ভালোবাসা দিয়ে বুঝিয়েও বলা যায় কিন্তু অবুঝ মা’কে কিভাবে বুঝাবে? সেক্ষেত্রে যন্ত্রনা প্রকাশ করতে না পারার কারনে মানসিক চাপ অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় ব্রেন স্ট্রোক এর মতো ঘটনা ঘটে।
আর এরকম ক্ষেত্রে ছেলেদের একটু কৌশলী হতে হয়, ভালোবাসা দিয়ে স্ত্রী’র সাথে শলাপরামর্শ করেই মা’কে সামাল দিতে হয়। মনে রাখতে হবে ‘মা’ জন্মদাত্রী, তাঁকে কোনভাবেই অসন্তোষ্ট করা যাবেনা। আবার বিয়ে করা বউ’কেও কিন্তু ধর্ম সাক্ষী রেখে তাঁকে ভালো রাখার দ্বায় কাঁধে নেয়া। কাজেই কৌশলী হতে হবে। কোন বউই স্বামীর ভালোবাসা পেলে তাঁকে সাপোর্ট না দিয়ে পারবে না। এই দুই সম্পর্ক ছাড়া বাকী সবক্ষেত্রেই ’টিট ফর টেট’ হওয়া উচিত, তবেই সব ঠিক।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। এমন করে সবাই বুঝে না। পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করতে পারে না। আমি মাঝে মাঝে তাঁর ওয়ালে যাই। ছবিগুলো দেখি। একটি সুখি পরিবারের ছবি। বাবা-মা, বোন, বউ, সন্তানদের নিয়ে হাস্যজ্বল সব ছবি। হাসির আড়াল আমরা কেউ দেখি না, দেখতে পাইনা…
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ছেলেদের মনের কথাগুলো তুলে ধরেছেন।ধন্যবাদ। -{@
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন, শুভকামনা জানবেন।
মেহেরী তাজ
আপনার বন্ধুর আত্মা শান্তি পাক আপু।
রিমি রুম্মান
ধন্যবাদ আপনাকে। ভাল থাকুন পরিবার নিয়ে।
শিশির কনা
কষ্ট লাগলো লেখাটি পড়ে।আপনার বন্ধুর আত্মার শান্তি কামনা করি।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুক সকলের পরিবার। শুভকামনা আপনাকে।