সাইকেল মানে স্মৃতি। স্মৃতি মানে কবিতা। কবি আল মাহমুদ লিখেছেন,
“কবিতা তো কৈশরের স্মৃতি
সেতো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিমডালে
বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাত জাগা
ছোট ভাই বোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের
ঘণ্টাধ্বনি——-রাবেয়া, রাবেয়া
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া
দক্ষিণের ভেজানো কপাট!”
‘ দস্যিটা কই গেলো রে? মা চিল্লাচ্ছে।
এই তো আমি এখানে, গাছের মগডাল থেকে বলছি।
মা কখনোই আমাকে মারতে পারেনি। তা তো আগের লাইন থেকেই বুঝতেছেন। আমারও দোষ নাই। পাড়ায় আমার সমবয়সী সব ছেলে, একটা মেয়েও নাই। ওরাও গাছে চড়া শিখে। আমি ওদের আগে শিখে ফেলি। যখন ক্লাস টু এ পড়ি, তখন সব ছেলেরা সাইকেলে হাফ প্যাডেল শিখে। আমিও আব্বারটা নিয়ে শিখি। এরপর রডে চড়া, তারপর ফুল প্যাডেল অর্থাৎ সিটে বসা। এখনকার ছেলে মেয়েরা বুঝবেনা হাফ প্যাডেল আর ফুল প্যাডেল কি? তখন সাইকেল ছিলো ২৪ ইঞ্চি। আমাদের বয়সীদের চালানো কঠিন ছিলো। আব্বা তো বাসায় সবসময় থাকে না। সাইকেলে চড়াও ঠিকমতো হয়না! আর হাতে পাইলে আসমানের চাঁদ।
আব্বাকে বললাম, সাইকেল কিনে দিতে হবে(ভয়ে ভয়ে)। আব্বা কোন রাগ দেখালো না। বললো, কাল অর্ডার দিবো। তখনকার দিনে সাইকেল আসতো ইন্ডিয়া থেকে। আমি ক্লাস ফাইভের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে এসে দেখি, লাল একটা সাইকেল আমার জন্য আনা হয়েছে। নাম এভোন। কিসের ড্রেস চেন্জ; কিসের খাওয়া। আব্বাকে ছালাম করলাম। উনি বললেন, “আমার তো ছেলে নাই! আমার অসুখ হলে, তুমি কলেজ মোড় থেকে ওষুধ এনে দিবে।”
তখন আমাদের ছোট্ট মহুকমা শহরে মেয়েদের ঘোরা ফিরায় ভালো চোখে দেখতো না; সেখানে সাইকেলে চড়ে স্কুলে যাওয়া, কেমনে জানি মেনে নিলো। বুঝলো, সিদ্দিক সাহেবের তো ছেলে নাই! মেয়েই ভরসা!
আব্বার ছিলো বাতের ব্যথা। ভল্টারেন ট্যাবলেট এর দাম এখন ১৪ টাকা। অথচ তখন ২৫টাকা করে আমি এনে দিতাম কলেজ মোড় থেকে।
একদিন আমাদের পাশের বাড়ির এক ছেলে আম গাছ থেকে পরে গিয়েছিলো। দুপুর ৩ টা হবে। গ্রীষ্মের ছুটি চলছিলো। আমি তখন ক্লাস টেন এ। মা, এসে ডাকছে ” মুক্তো মুক্তো”
জি, মা—-ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম।
একটু উঠে, সাইকেল নিয়ে যা। মোফাজ্জল ডাক্তার কে আনতে হবে। রেজাউল গাছ থেকে পরে গেছে।
মা, ওদের তো আরও ছয় ভাই আছে!
কেউ নেই বাসায়। মুখ ধুয়ে, তাড়াতাড়ি যা।
আমি ঝটপট সাইকেল নিয়ে বের হয়ে গেলাম। ডাক্তারের চেম্বার ভর্তি রোগি। উনি এম বি বি এস নন। তখন আমাদের গ্রামে এম বি বি এস ছিলো না। উনিই ছিলেন সব রোগের ডাক্তার।
“চাচা, বাসায় যেতে হবে!”
কেনো রে?
পাশের বাসার এক ছেলে গাছ থেকে পরে গেছে।
তুমি যাও। আমি একটুপর আসতেছি।
আমার তো এগুলো সহ্য হয় না। ওনার ডাক্তারি ব্যাগটা হাতে নিয়ে সাইকেলে উঠে দিলাম টান।
আর উনি যায় কোথায়? চিল্লাইতে চিল্লাইতে ওনার সাইকেল নিয়ে আমার পিছে পিছে আসলো।
উনি এমন ডাক্তার ছিলেন, এক ওষুধে আমাদের অসুখ ভালো হয়ে যেতো। উনি রোগি দেখে, প্রেসক্রিপশন দিলেন। ওনাকে আবার ব্যাগ সহ এগিয়ে দিয়ে এলাম। উনি শুধু মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “লক্ষ্মি মেয়ে!”
কেমনে কেমনে জানি, সাইকেলের সাথে, এমনি করে আমার সাথে সবার একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠলো।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
রাত হয়েছে, মা ডাকছে খেতে। আজ রাখি। সবশেষে আইনস্টাইন এর মতো বলতে হয়, ” জীবন হলো সাইকেলের মতো, সবসময় চালাতে হয়, তা না হলে পরে যেতে হয়।”
২৫টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
সাইকেল্টিবখুব ভাল সাথে এক্সহবি। পরে আবার আসব।
আরজু মুক্তা
শুভকামনা!
মোঃ মজিবর রহমান
🖖
অশোকা মাহবুবা
বাহ বেশ ডানপিটে ছিলেন তো। তবে রবিনহুড টাইপ ডানপিটে। ভালো লাগল আপনার স্মৃতিগুলো পড়ে।
আরজু মুক্তা
কি যে বলেন? এই মিষ্টি মেয়েটা কি ডানপিটে হতে পারে?
শুভকামনা!
বন্যা লিপি
আপাতত হাজিরা দিয়ে গেলাম।মন্তব্যে পরে আসছি।
আরজু মুক্তা
অপেক্ষায় থাকলাম।
সাবিনা ইয়াসমিন
সাইকেল স্মৃতি ভালো লাগলো। চড়ার মজা আর কাজে লেগেছিলো বলেই সময়গুলো এত আনন্দময় ছিলো। আগের ডাক্তাররা আসলেই ভালো ছিলো। একবার দেখালেই রোগী সুস্থ হয়ে যেতো। ২য়বার আর যাওয়া লাগতো না। এখনকার অবস্থা না বলাই বেটার। রোগ রোগী সবই আছে, শুধু সেই ডাক্তারেরা নেই।
শুভ কামনা 🌹🌹
আরজু মুক্তা
একদম ঠিক বলেছেন। ভালো লাগলো।
শুভকামনা
মোঃ মজিবর রহমান
সুন্দর একটি লেখা আপু এমন লেখা আসে কোন থেকে?
দস্যিপোনার মাঝে ও মানুসের পাশে থেকেছেন এটাও বড়।
কাজের মাঝে তফাত নাই কাজ করাই মুখ্য ব্যাপার।
লাস্টে আইন স্টাইনের পদ্ধতি খুব ভাল।
আগ্রহ থাক্ল পরে আবার লেখা পাওয়ার।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং আবার আসিব আমি
আরজু মুক্তা
কেমনে যে লিখা আসে, বুঝলাম না!
পরের লিখা এক সপ্তাহ পর।
অবশ্যই পড়বেন। ভালো থাকবেন।
মোঃ মজিবর রহমান
ইনশাল্লাহ।
মনির হোসেন মমি
সে সময় গ্রামে চলাচলে সাইকেলই ছিলো ভরসার বাহন।আমিও সাইকেল চালিয়েছি প্রথম দিনতো এক মুরুব্বির উপর দিয়েই চালিয়ে গেলাম।আমি সাইকেলটিকে যতই চেষ্টা করছি মুরুব্বি হতে নিরাপদে থাকতে সাইকেলটি যেন ততই মুরুব্বির দিকেই এগুচ্ছে।অবশ্য পরে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যায়।
বুঝায় যায় আপনি আপনার শৈশব জীবনটারে খুব উপভোগ করেছেন। খুব সুন্দর লেখা।
আরজু মুক্তা
হুম শৈশব খুব উপভোগ্য ছিলো।
ধন্যবাদ, লিখাটা পড়েছেন এবং স্মৃতিকাতর হয়েছেন।
শুভকামনা।
তৌহিদ
বিশ্বাস করেন আমি প্রথম সিটে বসে ফুল প্যাডেল শিখেছি। যিনি শিখিয়েছেন আমার খালু তি ক্যারিয়ারে বসে থাকতেন আমি চালাতাম। কিন্তু প্যাডেল ফুল হাতে পেতামনা 😃😃
এর অনেকদিন পরে হাফপ্যাডেল শিখেছি ☺☺
সাইকেল নিয়ে স্মৃতি কথা পড়তে গিয়ে নিজেই নস্টালজিক হয়ে পড়লাম। ভালো থাকবেন আপু।
আরজু মুক্তা
শৈশবকে মনে করিয়ে দিলাম।
সাইকেল আসলেই অনেক ঘটনা বহুল।
শুভকামনা!
রেজওয়ান
মজার ও সুন্দর ছিলো আপনার শৈশবকাল❤ভাল থাকুন সব সময় আপু✌
আরজু মুক্তা
একদম। সবারি শৈশব মজার, তাইনা?
আপনিও ভালো থাকুন।
রেজওয়ান
সবারটা সুন্দর হয় না হয়তো😐তবে আমি সব সময়ই ভাল থাকি আপু😇
ছাইরাছ হেলাল
আপনি তো দেখছি বনহুর টাইপ!!
ডাক্তারকেই কুপোকাত, এখন কোথায় কী করছেন কে জানে!
আরজু মুক্তা
আগে এক চোট হাসি। প্রথম পুরুষ দিয়ে গল্প লিখলে সবাই ভাবে, নিজের কাহিনী। তবে জীবন থেকে নেয়া। একটু বনহুর টাইপ। কিছু করার নাই। স্বভাব পালৃটায় না।
কখন যে আপনার মতো লিখে ফেলি। না জানি তখন কি বলবেন? ভালো থাকবেন।
শুভকামনা।
প্রদীপ চক্রবর্তী
শৈশবের বর্ণিল স্মৃতি আজ ধূসর দর্পণে হেম।
আমার বাবার হাতে সাইকেল চালানো শিখেছি
ছোটবেলা স্কুল থেকে সাইকেলে নিয়ে আসার সময় বৃষ্টি নামার আগে বাবা আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরবো বলে ; rain rain go away ছড়া টা বলতে বলতে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিতেন আর আমি বলতাম বাবা, আরো জোরে আরো জোরে। আমাকে বৃষ্টির আগে নিয়ে চলো বাবা।
যখন সাইকেল পুরোপুরিভাবে শিখে রাস্তায় বের হয়েছিলাম তখন রিকশাওয়ালার সাথে ধাক্কা খেয়ে জমিনে পড়ে কাঁধা মেখে বাড়ি ফিরছিলাম।
আজও মনে পড়ে শৈশবের অজস্র স্মৃতি।
ভালো লাগলো দিদি শৈশবের সাইকেল স্মৃতি পড়ে।
শুভকামনা অহর্নিশ।
আরজু মুক্তা
আপনাকেও ধন্যবাদ গল্পটা পড়ার জন্য। শৈশব এমনি। আর সাইকেল নিয়ে সবারি কম বেশি ঘটনা থাকে। আমারও ঐরকম ছিলো।
ভালো থাকবেন।
আকবর হোসেন রবিন
আপনার মতো এতো সহজে সাইকেল শিখতে পারিনি। কতোবার যে খালে পড়ে গেছি তার হিসাব নেই!
চাটিগাঁ থেকে বাহার
খুব মজা পেলাম আপনার লেখাটি পড়ে। ভালো লিখেছেন। সাইকেল নিয়ে আমার একটি লেখা আছে। ২০১৭ সালে এই ব্লগে পোস্ট করেছি। সময় পেলে পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি….