বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে ভুত দেখেনি বা ভুতের ভয় পায়নি এমন কোন বাঙালী খুজে পাওয়া কষ্টসাধ্য । অনেকে আছেন যারা সরাসরি দাবী করে ভূত দেখেছে । এবং সবাই কম বেশি ভুতের ভয় পেয়েছে । আমিও ভূত দেখেছি কয়েকবার আবার ভয়ও পেয়েছি । আজকে সে বিষয় নিয়ে কথা বলব ।
ক্লাশ এইটে পড়ি । সবে পাখনা গজাতে শুরু করেছে । বন্ধুদের সাথে বাসা থেকে দূরে ঘুরতে যাওয়া শুরু করেছি । মাসটা সম্ভবত জুন জুলাই । তখন আমাদের এখানের ডিসি অফিসের ছাঁদে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতাম আর মাঠে জল কাদা কম থাকলে ফুটবল খেলতাম । সন্ধার আযান দেয়ার সাথে সাথে যে যার মত বাসায় ছুটতাম । বাসায় আমার বাবা একটা মোবাইল ফোন কিনেছিল কিন্তু আমার হাত দেয়া নিষেধ ছিল । তো একদিন বাসায় কেউ ছিল না এই ফাকে আমি মোবাইলটা নিয়ে বেরলাম এবং আড্ডা যথারীতি ডিসি অফিসের ছাদ । স্বাভাবিকভাবে আড্ডা শেষ করে বাসায় ফিরলাম, কিন্তু মোবাইলটা কোথাও খুজে পাচ্ছিলাম না । পরে খেয়াল হল ছাঁদে মোবাইল রেখে এসেছি । তো ধরা খাওয়ার আগেই আবার ছুটলাম ডিসি অফিসের দিকে । ডিসি অফিস একটা বিশাল তিন তলা ভবন নিয়ে তৈরি । সন্ধ্যা হয়ে গেছে এবং এলাকাটা পুরো ফাকা । ঝাপসা অন্ধকারে খুব ভয় করছিল তিন তলার ছাঁদে উঠতে । কিন্তু আমাকে তো উঠতেই হবে । খুব ধিরে ধিরে ছাঁদে উঠলাম আর মোবাইলটাও খুজে পেলাম । কিন্তু তখন খেয়াল হল বেশি দেরি হলে বাসা থেকে ঝাড় খাব তাই দৌড়ে নামা শুরু করলাম । কিন্তু সিঁড়িতে দৌড় শুরু করতেই স্পষ্ট শুনতে পেলাম কেউ একজন পিছন পিছন দৌড়ে আসছে । সাথে সাথে পিছন দিকে তাকালাম কিন্তু একদম ফাকা কেউ নেই । বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল । আমি আর এক পাও বাড়ানোর সাহস পেলাম না । এদিকে ওখানে দাড়িয়ে থাকতেও খুব ভয় করছিল । মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে । কেউ যেন লোমশ কালো হাত দিয়ে আমার গলা চেপে ধরছে । অনেক কষ্টে আবারও দৌড় শুরু করলাম । কিন্তু সেই একই বিষয় । আবার কেউ পিছনে দৌড়াচ্ছে । আর সহ্য করতে পারলাম । গলা ছেড়ে কান্না শুরু করলাম । আমার কান্না শুনে ডিসি অফিসের গাঁজাখোর নাইট গার্ড দৌড়ে আসল । ততক্ষণে আমার জ্ঞান প্রায় লোপ পেয়েছে । নাইটগার্ড আমার বাবাকে চিনত । সে আমাকে রিকশায় করে বাড়ি পৌঁছে দিল । কিন্তু সারারাতে কিছু খেতে পারলাম না । পরের দিন সকাল থেকে শুরু হল জ্বর । প্রায় দুই সপ্তাহ অসুস্থ ছিলাম । কিছু খেতে পারতাম না । ২য় সাময়িক পরীক্ষা প্রথম ১ টা দিতে পারি নি । সুস্থ হওয়ার পরও আমার ভয় একটুও কমে নি । ভয়ে আমি ডিসি অফিসের দিকেও তাকাতাম না । এবং এই ঘটনার অনেকদিন পরও আমি ডিসি অফিসের সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম না ।
এই ঘটনার ৫/৬ বছর পর সব কিছু যখন ভুলে গেছি ভুতের ভয়ও কেটে গেছে তখন একদিন রাতে ডিসি সাহেব ও সমাজ সেবা কর্মকর্তার সাথে আমাদের জেলার কয়েকটি সামাজিক সংগঠনের একটা জরুরি মিটিং অনুষ্ঠিত হচ্ছিল ইভ টিজিং প্রতিরোধ করার ব্যাপারে । আমিও ছিলাম সেই মিটিংএ একটি সংগঠনের প্রতিনিধি হিসাবে । স্বাভাবিক ভাবে ৭ টার অনুষ্ঠান শুরু হতে হতে ৮ টা বেজে গেল । এবং শেষ হল ১০ টার দিকে । অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর যে যার নাস্তা নিয়ে চলে গেল । কিন্তু আমাদের সংগঠনের সভাপতি কি একটা কাজে যেন ডিসির পি এস এর সাথে কথা বলছিল । এবং আমাকে অপেক্ষা করতে বলল । আমি এদিক সেদিক হাটাহাটি করছিলাম । হঠাৎ কি মনে করে যেন তিন তলায় উঠলাম । এদিক সেদিক ঘুরে তিন তলা থেকে যখন একটু দ্রুত নামতে যাব তখন আবার সেই শব্দ । পিছন থেকে কে যেন ধেয়ে আসছে । তখন ছোট বেলার সেই স্মৃতি আবার মনে পড়ে গেল । আমারও জেদ চেপে গেল আসল ঘটনা কি জানতে হবে । আমি কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকলাম । এবং খুব জোরে একটা পা নিচের ধাপের সিঁড়িতে ফেললাম । সিঁড়িতে পা ফেলার সাথে সাথে আবারও শুনতে পেলাম কে যেন আমার পিছনে পা রাখল । যতবার আমি আমার পা ফেলছি ঠিক ততবারই পিছনে শব্দ হয় । আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে বড় ভবনে আমার পায়ের শব্দ দেয়ালে ও ছাঁদে লেগে প্রতিধ্বনি হয় এবং এই শব্দ শুনেই আমি ছোট বেলায় ভয় পেয়েছিলাম এবং নাইটগার্ড সেদিন সময় মত না আসলে হয়ত ভঁয়ে মরেই জেতাম । এখন খুব হাসি পায় এই ঘটনার কথা মনে পড়ে । এবং খুব হাঁসতে হাঁসতে আগ্রহ নিয়ে মানুষকেও বলিও । কিন্তু ভয়ের সরূপটা কি তা সেদিন বুঝেছিলাম ।
২য় ঘটনা টি ঘটেছিল বাংলা চৈত্র মাসের কোন এক পূর্ণিমা রাতে । এস এস সি পরীক্ষা শেষ । তিন মাসের ছুটি । আমাকে আর কে পায় । সারাদিন শুধু ঘুরে ঘুরে বেড়াই । আমাদের গ্রামে চৈত্র মাসে অনেকগুলো বাসন্তী পূজা হয় খুব জাঁকজমকের সাথে । যেহেতু আমার কোন কাজ নেই সেহেতু আমি গ্রামে পূজা দেখতে গেলাম । গ্রামে আমার সমবয়সী এক কাকা ছিল সেও এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছে । এবং আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে মৌরি সেও এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসল এবং মা গ্রামে আসার সময় তাকে নিয়ে আসল । সুতরাং আমাদের সঙ্গি আরেকজন বেড়ে গেল । ঢাকার মেয়ে মৌরি গ্রামে যা দেখে তা দেখেই অবাক হয় । আর আমরা তিনজন মিলে বিল বাগান পুকুর পাড় দিয়ে স্বাধীনমত ঘুরে বেড়াই । খেত থেকে শসা ছিঁড়ে খাই । বড়শী দিয়ে মাছ ধরি । আর প্রতিদিনই পূজার অনুষ্ঠান দেখে অনেক রাতে বাড়ি ফিরি । সেদিন সম্ভবত দশমী ছিল । সব পূজা মন্ডপেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে । আমারও মিশন ঠিক করলাম যত কষ্টই হোক সব গুলা পূজা মন্ডপ ঘুরে ঘুরে দেখব । যেহেতু শাসন করার কেউ নেই সেহেতু আমরা রাত ১ টার দিকে বাড়ির দিকে হাটা শুরু করলাম । সেদিন এমন জোছনা ছিল যে ইচ্ছা করলে বই পড়া যায় । হেটে হেটে যখন বাড়ির একেবারে কাছে চলে এসেছি ঠিক তখন মৌরি খুব শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরল । আমি ওর দিকে তাকাতেই ও বলল শুভ্র ঐ দেখ কি দাড়িয়ে আছে । তাকিয়ে দেখি রাস্তার পাশে কুকুরের চেয়ে একটু বড় কাটাওলা একটা প্রাণী আমাদের দিকে দাত বের করে তাকিয়ে আছে । চাদের আলোয় দাতগুলো ঝক ঝক করছে । আমরা তিন জন তো ভয়ে শেষ । সামনে যাওয়ার মত সাহসও নেই আবার পিছিয়ে যাওয়ার মত উপায়ও নেই । তিন জনই খুব ঘাবড়ে গেলাম । তখন কাকা বলল , আমি তো এই রাস্তা দিয়ে অনেকবারই রাতে চলাফেরা করেছি কিন্তু কোনদিন তো কিছু দেখি নাই । আয় সামনে এগিয়ে দেখি ওটা কি ???? আমি আর মৌরি ওর কথায় ঠিক ভরসা পাচ্ছিলাম না । কিন্তু দাড়িয়ে থেকেও তো কোন ফায়দা নেই আর আশেপাশে অনেক বাড়িও আছে । চিৎকার করলে মানুষ আসবে তাই মৌরির তিব্র আপত্তি ষত্বেও হাটা শুরু করলাম । যত কাছে যেতে থাকলাম ততই প্রাণীটি ছোট হতে থাকল । এবং শেষ পর্যন্ত দেখলাম যেখানে প্রাণীটি বসা ছিল সেখানে কিছুই নেই একটা ছোট খেজুর গাছে অনেকগুলো খড় জড়ানো আছে । আমরা তো পুরা অবাক, দেখলাম ভয়ংকর একটা প্রাণী আর হয়ে গেল খেজুর গাছ । আমরা আবার পিছনে সরে আসলাম এবং পিছন থেকে দেখলে সত্যিই আবার প্রাণীর মত লাগে । কিন্তু কাছে গেলে আবার খেজুর গাছ !!!!! সেদিন আমাদের চিৎকারে কেউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে না আসলেও হাসির শব্দে অনেকেই বেরিয়ে এসেছিল ।
এই দুই বারই আমি বাংলা ভূত দেখেছি । এবং পরে প্রাণ খুলে হেসেছি । আপনারা কেউ দেখে থাকলে শেয়ার করুন । আরেকটু প্রাণ খুলে হাশি ।
বাংলা ভূত নিয়ে আরও পড়ুনঃ http://sonelablog.com/archives/8412
১২টি মন্তব্য
আদিব আদ্নান
যাক, ঘাড় মটকে দেয়নি এই যা , সাবধানে থাকবেন !
"বাইরনিক শুভ্র"
পেত্নিতেই ঘাড় মটকাতে পারল না আবার ভূত 😀 ।
ধন্যবাদ ।
খসড়া
ভুত আমার পুত পেত্নী আমার ঝি
"বাইরনিক শুভ্র"
বুয়ার খুব সঙ্কট । একটা পেত্নি ঝি সাপ্লাই দিতে পারেন কিনা দেখেন :p
জিসান শা ইকরাম
হা হা হা , খেজুর ভুতটা ভালো লাগছে বেশী 🙂
"বাইরনিক শুভ্র"
আমারও । অনেক মজা পেয়েছিলাম সেদিন রাতে । 🙂
শিশির কনা
ওরে বাবা , আজ রাতের ঘুম শেষ
"বাইরনিক শুভ্র"
দিনে ঘুমাইয়েন । :p
স্বপ্ন
:D) :D) :D) :D) , সোনেলায় আবার ভুত আনবেন না ভাই । মজা পেয়েছি।
"বাইরনিক শুভ্র"
আমার ভুতের স্টক “খেজুর ভুতেই” শেষ হয়ে গেছে । ;(
শুন্য শুন্যালয়
খেজুর ভুত :p 😀
দাড়াও আমিও একটা ভুত নিয়ে আসতেছি সোনেলায়… 🙂
"বাইরনিক শুভ্র"
ভালোই হয় । দুই ভাই বোনের পোষা ভূত থাকলে আমাদের আর কে পায় । 🙂 😀