আমার একটা নদী ছিল

দীপংকর চন্দ ৪ মে ২০১৬, বুধবার, ০৯:০৬:০৯অপরাহ্ন বিবিধ ২৬ মন্তব্য

নদী

 

একেবারেই ছোট যখন, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় যখন যুক্ত হয়নি কোন নদী, মোটামুটি তখনকার কথা!
বয়োজ্যেষ্ঠদের গল্পের নানা সূত্রে এবং বহু ধরনের শিশুতোষ বইয়ের অক্ষর ছুঁয়ে একটা নদী জন্ম নিল আমার বুকের ভেতর! কাকচক্ষু জলের নিস্তরঙ্গ সেই নদীর বাঁকে বাঁকে সরলতা! দৈর্ঘে-প্রস্থে-রূপে-সৌন্দর্যে অনন্য সেই নদীর দুকূল জুড়ে প্রণিধানযোগ্য পরিচ্ছন্নতা!
নদীটির একটা নাম দেয়া দরকার! নামহীন কোন কিছুর সাথে আত্মীয়তা যেন ঠিক জমে না!
কি নাম দেয়া যায় নদীটির? সমবয়সীদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম প্রথমে।
তারা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে! অনোন্যপায় হয়ে বড়দের দ্বারস্থ হলাম!
আমার কথা তাঁরা ভাল করে শুনলোই না। বরং স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যে এসব উদ্ভট চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার আদেশ দিল আমাকে।
কিন্তু আমার তখন শয়নে স্বপনে নদী! নদীর নাম আমার অবশ্যই চাই! আমি নিজেই তখন নদীর নাম খোঁজার চেষ্টা করলাম! একটা ভীষণ সুন্দর নদীকে নামহীন রাখার অপরাধ কাঁধে নেয়া যায় না কিছুতেই!

কয়েকদিন কয়েকরাত চেষ্টার পর একটা নাম শিশিরস্নাত শিউলির মতো ঝরে পড়লো ভাবনার সবুজ আঁচলে! ‘মালঞ্চ’। চেতন কিংবা অবচেতনের কোন স্তর থেকে, কোন আধিভৌতিক অভিজ্ঞতার আদ্যকেন্দ্র থেকে এই নামের জন্ম কে জানে, তবে মালঞ্চ নামটা বেশ মানিয়ে গেল আমার বুকের গহীনে বাসা বাঁধা নদীটির সাথে!

নদীর নাম দেবার ব্যাপারে কারো কোন আগ্রহ কিংবা উৎসাহ না থাকলেও নদীর নাম শুনে এবার কিন্তু নড়েচড়ে উঠল সকলে। শুরু হল নানাজনের নানামুখী আলোচনা, সমালোচনা, মন্তব্য!
দূর! নদীর নাম আবার মালঞ্চ হয় নাকি!
এমন কথা শুনে আমার শিশুমুখটা ম্লান হল স্বাভাবিকভাবেই। পাশাপাশি আবোধ্য একটা জেদও তৈরী হল ভেতরে। যে যাই বলুক, আমার নদীর নাম মালঞ্চ-ই! মালঞ্চ নামের নদী অবশ্যই হয়! বড় হয়ে মালঞ্চ নামের নদী খুঁজে বের করে আমি দেখিয়ে দেব সবাইকে!

এই জেদ আমার অটুট রইল পরবর্তী জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে।
বিভিন্নমুখী কাজ কিংবা অকাজের পাশাপাশি শুরু হল একটা নদী খোঁজার খেলা।
শৈশবের শেষপর্যায়ে বাস্তবিকঅর্থে প্রথম নদী দেখলাম আমি। আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত মহল্লার পাশেই ছিল ধোপাপাড়া। ধোপাপাড়ার মানুষগুলো ছিল জলের আত্মীয়। বিভিন্ন জলাশয়ের সাথে ঘনিষ্ট পরিচয় ছিল তাদের। শুধু বড়রাই নয়, ধোপাপাড়ার ছোট ছোট অসীম সাহসী শিশুরাও নিকটবর্তী জলাশয়গুলোর খোঁজখবর রাখতো বেশ ভালভাবেই। অভিভাবকদের নিষেধ মানার দেয়াল টপকে একদিন ধোপাপাড়ার শিশুদের সাথে বেরিয়ে পড়লাম আমি। চেনা পৃথিবী পেছনে ফেলে মালঞ্চ নদী খুঁজতে গিয়ে পরিচয় হল বাস্তব জীবনের প্রথম নদী শীতলক্ষ্যার সাথে ।
তারপর অতিবাহিত হয়েছে অনেক সময়। বুকের ভেতরে থাকা নদীর বাস্তব অস্তিত্ব অনুসন্ধান করতে করতে কত নদ-নদীর বাঁকে ঘুরেছি আমি! পদ্মা-মেঘনা-যমুনা! গঙ্গা-বুড়িগঙ্গা-নবগঙ্গা! ব্রহ্মপুত্র-আঁড়িয়াল খাঁ-কপোতাক্ষ! মাতামুহুরি-হালদা-কর্ণফুলি! কুমার-নারদ-ভৈরব! পুর্নভবা-করতোয়া-মহানন্দা! সোমেশ্বরী-ধলেশ্বরী-ফুলেশ্বরী! সন্ধ্যা-সুগন্ধা-কীর্তনখোলা! ইছামতি-শঙ্খ-বিষখালি!
নানা নদীর বাঁকে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ খুঁজে পেলাম ময়ূর নামের একটি নদীকে। খুলনা মহানগরীর প্রান্ত ছুঁয়ে প্রবাহিত হয়ে রূপসা নদীর সাথে মিলিত হওয়া এই নদীটি আশা বাড়িয়ে দিল আমার। কেন জানি মনে হল মালঞ্চ নদী খুঁজে পাওয়া মূলত সময়ের ব্যাপার!

ঘুরে বেড়ানোর আগ্রহ থেকে সাতক্ষীরার জেলার কালিগঞ্জ উপজেলায় গেলাম। কাকশিয়ালি নামের একটা খরস্রোতা নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে লোকালয়। বাসস্ট্যাণ্ডের পাশেই মাছের আড়ত। প্রখর বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন আড়তদার মো.আফসারের সাথে পরিচয় হল। তিনি বললেন সুন্দরবনের কথা।
কালিগঞ্জ থেকে খুব বেশী দূরে নয় সুন্দরবন! একবার ঘুরে গেলে মন্দ হয় না! ভাবনার সূত্র ধরেই চেপে বসলাম বাসে। কালিগঞ্জ পেছনে ফেলে শ্যামনগর। শ্যামনগর পেছনে ফেলে মুন্সিগঞ্জ।
মুন্সিগঞ্জ পৌঁছে থেমে গেল বাস। আমাদের নামতে হবে এখানেই। এরপর হাঁটতে হবে আবার।
কিন্তু সুন্দরবন কোথায়? সামনে দাঁড়ানো একজন ডাববিক্রেতার কাছে জানতে চাইলাম।
তিনি আঙুল তুলে নিস্পৃহ স্বরে বললেন, এইতো!
কৌতুহলী দৃষ্টিতে আমি তাকালাম তার আঙুল নির্দেশিত দিকপ্রান্তে। একি! এ যে সত্যি! সত্যিই তো সুন্দরবন আমার দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে! কী ভীষণ অপার্থিব ঔদাসীন্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দ্যসুন্দর বনটি!
বর্ণনাতীত সৌন্দর্যের একটা স্বর্গীয় নদীও আছে সামনে!
সুন্দরবনের সাথে লোকালয়ের বিভাজন রেখা টেনে কি মৌনমুখরভাবে নদীটি বয়ে চলেছে অমরাবতীর দিকে! আবেগের আতিশয্যে প্রায় বাকরুদ্ধ আমি অস্ফুটস্বরে জানতে চাইলাম, কী নাম এই নদীর?
কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোন এক অচেনা গ্রহ থেকে যেন উত্তর ভেসে এল, ‘মালঞ্চ’!
অভূতপূর্ব আনন্দে অবগাহন করতে করতে আমি আবিষ্কার করলাম, আমার বুকের ভেতর বসবাস করা মালঞ্চ নদীর চেয়ে বাস্তবের মালঞ্চ নদী অনেক বেশী রূপবতী, অনেক বেশী নান্দনিক, অনেক বেশী ঐশ্বর্যশালী!

 

ছবি: সংগৃহীত

 

 

৬৮৩জন ৬৮২জন

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ