মা-বাবা, পাঁচ ভাই-বোন নিয়ে ছিলো আমাদের পরিবার। তখন ঈদ আসা মানেই একরাশ আনন্দ নিয়ে ঈদের অপেক্ষা করা। একটা নতুন জামার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষার প্রহর গোনা। নতুন জামা হাতে পেলে তা লুকিয়ে রেখে আনন্দক্ষণের অপেক্ষা করা। ওদিকে দুদিন আগে থেকেই আম্মার একটু একটু করে শুকনো নাস্তা বানিয়ে রাখা।
চাঁদরাতে সন্ধ্যা হতেই উঠোনে বের হয়ে ঈদের নতুন চাঁদ খুঁজে বেড়ানো। দিনের বেলায় সমস্ত পাড়া ঘুরে পাড়ার একদল দস্যি ছেলে নারকেল কুড়িয়ে রাখার পর যে খুলিটা ফেলে দেয়া হতো সেটা জোগাড় করে রাখতো। নতুন চাঁদ দেখার পর সকলে মিলে পুরো চাঁদরাতটাকে আলোকিত করে তুলতো। আহা! কি সুন্দর সে দৃশ্য ছিলো!! চাঁদ দেখার সাথেসাথেই পাড়ার সামনে বড় পুকুটিতে কম করে হলেও ৪০/৫০টি নারকেল খুলিতে কেরোসিন তেল ঢেলে সলতে দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে তা পুকুরে ভাসিয়ে দিতো। একঝাঁক প্রদ্বীপ পুকুরে ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রায় ঘন্টা সময় ধরে সেগুলো জ্বলতে থাকতো আর নতুন চাঁদের অন্ধকার রাত্রিতে কি অপরুপ সে দৃশ্য দেখা যেতো একবার ভাবুন। এখনকার ছেলেপেলেরা এই আনন্দ কই পাবে?
ঈদের দিন সকালবেলা ভোরে ঘুম থেকে জাগা ছিলো অনেকটা বাধ্যতামুলক এবং সে বাধ্যবাধকতায় কোন বিরক্তি তো ছিলোই না, ছিলো আনন্দ আর উচ্ছ্বাস। যথারীতি আম্মা রান্নাঘরে আর আব্বার হৈ-হুলুস্থুল গোসল করা নিয়ে। একের পর এক বাথরুমে যাচ্ছে আর গোসল সারা হচ্ছে। প্রথমে দুই ভাই আর আব্বা, যেহেতু তারা ঈদ জামাতে যাবে। আমরা বোনরা তাদের সাজগোজের কাপড়, জায়নামাজ এগিয়ে দিচ্ছি (আগের রাতেই সব ঠিক করে রাখা হতো), আম্মা টেবিল সাজাচ্ছেন। গোসল শেষ তিনজনের, তৈরি হয়ে মিষ্টিমুখ করে তিনজন মিলে ঈদ নামাজে রওয়ানা। শুরু হলো আমাদের পালা। আম্মার নির্দেশণা থাকতো, ঈদ জামাত শেষ হয়ে সবাই ঘরে ফেরার আগেই সব ফিট থাকতে হবে। এই ফিটনেস মেইনটেইন করতে গিয়ে আগের রাতেই ঘরদোর এক্কেবারে পরিপাটি করে গুছিয়ে ফেলা হতো, যেনো ছবির মতো। ব্যস, ফটাফট সবাই গোসল (বাধ্যতামূলক ছিলো, এমনকি কঠিন শীত হলেও) সেরে তৈরি। একেবারে পটের বিবির মতো। উল্লেখ্য, সারাবছরে একমাত্র এই দুই ঈদেই দেখতাম আম্মা তার স্বর্ণালঙ্কারগুলো সব পরতেন। সারা বছরে এই দুটো ঈদে আম্মাকে নতুন সাজে অপরুপ লাগতো। বরাবর এই ব্যাপারটা ছিলো আমাদের জন্য ঈদ স্পেশাল।
নামাজ থেকে ফিরে শুরু হতো আনন্দ আড্ডা! দলে দলে লোক আসছে-যাচ্ছে। আত্মীয় পরিজন আসছেন, কুশল বিনিময় আর ঈদ মোলাকাত করছেন। আমাদের বন্ধুগ্রুপ একেকবার একেকদল আসছে। তাদের সাথে আবার কেউ কেউ বেরিয়ে যাচ্ছে। পাড়াপড়সী আসছে। টেবিলে নাস্তা সাজানো গুছানো। শেষ হচ্ছে আবার পরিবেশন করা হচ্ছে। এমন করে দুপুর বারোটা পর্যন্ত জমজমাট চলতেই থাকতো। এরপর যেনো একটু বিরতি, একটু ফাঁকা।
দুপুর একটা দেড়টার মধ্যে দুপুরের খাবার সাড়া হয়ে যেতো এদিনটায়। কোরমা-পোলাও আর চপ, সালাদ থাকতো খাবার মেনু। বিকালে আব্বা-আম্মা ছাড়া আর কেউই বাসায় থাকতাম না। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বের হয়ে যেতাম ঘুরে বেড়াতে। এ সময়টাতে দূর দূরান্তের আত্মীয়রা বাসায় আসতেন আব্বা-আম্মার সাথে দেখা করতে। মফস্বল শহরে রাস্তায় বের হলেই দেখা যেতো মোড়ে মোড়ে হাই ভলিউমে গান বাজছে। তখন ব্যান্ড সঙ্গীতটাই ছিলো বেশ জমজমাট।
তবে যতো যাই হোক, সন্ধ্যার পরে বাসায় থাকাটা ছিলো বাধ্যতামূলক। এমনকি ঈদের দিন হিসাবেও এতে কোন ছাড় ছিলো না। ব্যত্যয় ঘটলে দেখতে হবে আম্মার অগ্নিমূর্তি, সুতরাং সন্ধ্যার পর সকলে বাসায়। বসতো পারিবারিক আড্ডা আর বেড়াতে আসা মেহমানদের সাথে আতীথেয়তা। এর মাঝে বিনোদন ছিলো টেলিভিশন দেখা। ছিলো কেবল বিটিভি! এরপর একসময় আসলো বিভিন্ন চ্যানেল। তবে বিটিভির কালটাই ছিলো সর্বাধিক আনন্দের।
আহা! সেকালের ঈদ আনন্দ!!! সেসব দিনের ঈদকে এখনো ভীষণ ভীষণ মিস করি।
ঈদ মোবারক……..
৮টি মন্তব্য
মিষ্টি জিন
সত্যি আপু আমাদের লেই সময়কার ঈদের মজাই ছিল অন্যরকম । আমরাও অনেকটা এমন ভাবেই ঈদ পালন করতাম। আব্বা নামাঁয থেকে ফেরার আগেই একেবারে ফিটফাট হয়ে থাকতে হোত । আমার আম্মাও ঈদের দিন নতুন শাডি সোনার গয়না পড়তেন । বিদেশে থাকলেও এই নিয়মগুলে আমি আমার সংসারে ধরে রেখেছিলাম। জানি না আমার মেয়েরা কতটুকু ধরে রাখবে ।
ছোটবেলার ঈদের কঁথা মনে করিয়ে দিলেন আপু।
মিষ্টি জিন
ঈদ মোবারক আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ঈদ মোবারক……
জিসান শা ইকরাম
আমার ছোটবেলার ঈদও অনেকটা এমনই ছিল। আন্তরিক, প্রাণোচ্ছল, আনন্দে ভরপুর।
তবে পুকুরে প্রদীপটা আমি দেখিনি কখনো, আপনার পোষ্ট পড়ে কল্পনায় দেখলাম।
আজকাল আর এমন আনন্দ নেই,
ছেলে পুলেরা দেখি ফেইসবুক নিয়ে বসে থাকে 🙂
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অনেকদিন পর আসা হলো। ঈদের পরেই চিকনগুনিয়ায় কাবু।
যাহোক, আজকালের ছেলেপুলেরা ঈদে তেমন উচ্ছ্বাস করার সুযোগও যেমন পায় না আবার ইন্টারনেটের দুনিয়া সবাইকে বন্দি করে ফেলেছে। এর প্রভাবে বাচ্চারা আত্মকেন্দ্রিক হয় উঠছে।
নীহারিকা
ছোটবেলার ঈদের কথা মনে হলেই মন খারাপ হয়ে যায়। কত আনন্দময় ছিলো সেই দিনগুলো। আপনার আমিও মিস করি ছোটবেলার ঈদ।
ঈদের শুভেচ্ছা আপা।
ব্লগার সজীব
ছোট বেলার ঈদের আনন্দ এখন আর পাইনা আপু। ঈদ মোবারক -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
শুভেচ্ছা আর কি দেবো, মাস যে গড়িয়ে চললো! তবুও শুভেচ্ছা রইলো।