রোমান গ্ল্যাডিয়েটরদের চেয়েও আমাদের অবস্থা খারাপ।একটা গ্ল্যাডিয়েটরের তবু কিছুটা আশা থাকতো,একটা সিংহের সঙ্গে ঝুটোপুটি করতে করতে সে জিতেও যেতে পারে।কিন্তু এখানে?সেই ঝুটোপুটি করার সুযোগটুকু পর্যন্ত নেই।হাত আর চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে ,কটকট করে কতগুলো গুলি ছুটে যাচ্ছে ,মুহুর্তে লোকগুলো মরে যাচ্ছে এইরকম অবস্থার মধ্যে লেখাপড়া করে মানুষ হবার প্রক্রিয়াটা খুব বেশি সেকেলে বলে মনে হচ্ছে না কি?

 

”তুইতো এখানে পড়বিনা ।আই আই টিতে তোর ক্লাস শুরু হবে সেপ্টেম্বরে ,তোকে না হয় কয়েকমাস আগেই আমেরিকা পাঠিয়ে দেব ।“

 

আম্মা,দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকা পাঠিয়ে দাও,আমি হয়তো যাবো শেষ পর্যন্ত।কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মত অপরাধী করে রাখবে আমাকে।আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইন্জিনিয়ার হবো,কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনদিন ও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবনা ।তুমি কি তাই চাও আম্মা ?

 

কলেজের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় উজ্জ্বল তারকা রুমী কোনদিনই হারেনি প্রতিপক্ষের কাছে।সেদিন ও মায়ের কাছে বিজয়ী হয়েছিলো রুমি।ছেলের অটল দেশপ্রেমের প্রতিজ্ঞা থেকে মা জাহানারা ইমামও হুঙ্কার ছেড়েছিলেন-

 

“জননী তার জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বললেন “না ,তা চাই নে ।ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম।দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে ।যা,তুই যুদ্ধেই যা।”

 

 

উপরের সংলাপগুলো কাল্পনিক নয় ,কোন সংলাপ বুদবুদে ভাসা আবেগের আতিশয্য নয়,সত্য গল্প নয় ,গল্পের মত সত্য,কোন এক অলৌকিক উপায়ে হয়ে যাওয়া আমাদের সবার গল্প।ভাষা আন্দোলনের আগের বছরের ২৯ মার্চ ছেলেটির জম্ন।প্রিয় কবি জালালুদ্দিন রুমীর মতো জ্ঞানী ও দার্শনিক হবে এই চিন্তা করেই শিশুটির ডাকনাম রাখা হয়েছিল রুমী প্রিয়জন্দের স্নেহছায়ায় ক্রমশই শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে উপনীত হয়েছিলেন।

 

 

আদমজী স্কুল এ- কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে ছেলেটি।এস এস সি এইচ এস সি দুটোতেই ভালো রেজাল্ট,তারপর ইন্জিনিয়ারিং কলেজে(বর্তমান বুয়েট ভর্তি হওয়া।পাশাপাশি ঢাবির অর্থনীতি বিভাগে অনুমতি সাপেক্ষে ক্লাস।শুধুই জ্ঞান অন্বেষণে মার্কস মাও কন্ঠস্থ,গেরিলা যুদ্ধের প্রতি আগ্রহ,উজ্জল এক তারুণ্যর প্রতিচ্ছবি,সে যেন খুঁজে ফিরছিল আরেক চে গুয়েভারা।অবশেষে নিয়তি তাকে পাইয়ে দিল যুদ্ধের স্বাদ।এ এমন সন্তানের গল্প যে তার মা কে বলেছিল লিউন উরিসের লেখা মাইলা -১৮ পড়তে যাতে তার মা সেই বইয়ে লেখা নাত্‍সী বাহিনীর বর্বরতা পড়ে নিজেকে প্রবোধ দিতে পারে।আর সে কারণেই ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়ার সুযোগ পেয়েও যুদ্ধ শুরু হবার দরুণ সে সুযোগটি তিনি গ্রহণ করেননি।

 

 

মায়ের সে কলিজার টুকরা  ছেলেই দেশের জন্য যুদ্ধ করতে দুইবারের চেষ্টায় মেলাঘরে গিয়ে হাজির হয়েছিল।পড়েছিল কে ফোর্সের খালেদ মোশাররফের হাতে। খালেদ মোশাররফ ক্যাপ্টেন হায়দারের হাতে তুলে দেন রুমীদের। একজন রুমীর বীর রুমী হয়ে ওঠার পেছনে ক্যাটেন হায়দারের অবদান বোধহয় সবচেয়ে বেশী,ট্রেনিং শেষে রুমীর অবদান নতুন করে বলা হয়তো লাগে না কারণ তারপরের তার জীবনের প্রতিটি পরিচ্ছেদ হয়ে আছে মহাকাব্যের অংশ হয়ে আছে বাংলাদেশের সোনালী ইতিহাসের পাতায় পাতায়।

 

rsz_1rumi1

 

 

২৫ শে অগাস্ট ক্র্যাক প্লাটুনের সহযোদ্ধাদের নিয়ে রুমীরা ধানমণ্ডি ১৮ নম্বর রোডে অপারেশন চালায়। রুমীদের গাড়িকে এক হানাদার জিপ পিছু ধাওয়া করেছে দেখে রাইফেলের বাট দিয়ে পেছনের গ্লাস ভেঙ্গে ব্রাশফায়ার করে রুমী,ধ্বংস হয় হানাদাররা।সেটাই ছিলো রুমির শেষ অপারেশন এরপর ২৯ আগস্ট নিজ বাসা থেকে বাবা আর ছোট ভাই সহ তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানীরা।

 

 

হানাদার টর্চার সেলে প্রচন্ড নির্যাতন দাতে দাত চেপে সহ্য করেছিল রুমী কিন্তু মুখ থেকে একটা শব্দ বের হয়নি। পায়ের নখ সব তুলে ফেলে হয়েছিল টেনে,গায়ের চামড়া ছাড়াতে বাদ দেয়নি পশু গুলো তাকে।এত অত্যাচারের পরও রুমী বাবা আর ছোট ভাইকে বলেছিলো তোমরা কিছু স্বীকার করবে না আমি তোমাদের কিছুই বলি নাই।বাবা-আর ছোট ভাই জামী পরে ফিরে এলেও আর কোন দিনো ফিরে আসে নাই মায়ের বুকের সাত-রাজার  মানিক রুমী।রুমীকে ছাড়িয়ে আনার জন্য অনেকেই রুমীর বাবাকে ইয়াহিয়ার নিতশর্ত ক্ষমার সুযোগ নিতে বলেছিলেন কিন্তু বুঝতে হবে রুমীর ধমনীতে কার রক্ত। ছেলে হারানোর কষ্ট বুকে চেপে বাবা শরীফ ইমামও পাক হানাদার সরকারের কাছে মাথা নিচু করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।প্রাণভিক্ষা চাননি ,চান নি এতটুকু করুণা ।এ এমন পিতার গল্প যিনি শত অপমান বেত্রাঘাতেও টলেননি এতটুকু।এ এমন জননীর গল্প যিনি খলীল জিবরানের প্রফেট থেকে লাইন আউড়ে মনকে শক্ত করেছেন,পুরো পরিবার যেন নীলকণ্ঠ।পুরাণে এক দেবতা বিষ নিজের গলায় ধারণ করে বাঁচিয়েছিল বিশ্ব,নিজে হয়েছিল নীলকণ্ঠ।এই পরিবার ,এই গল্প,এই পিতা পুত্র জননীরাও যেন তাই।আমরা দুর্ভাগ্যবান তাদের নষ্ট বীজ আজো বিষবৃক্ষ ছড়িয়ে দিচ্ছে শ্যামল বাঙলায়,যার জন্য গল্পের জননীকে,আমাদের জননীকে পেতে হয় রাষ্ট্রদ্রোহীর অভিধান।এরচেয়ে বড় জঘণ্য অনাচার পৃথিবীতে আর কি হতে পারে?

 

 

রুমী আর ফিরে আসেনি,আসবেওনা অথচ ছেলেটি গড়পড়তা আর দশটি উচ্চবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছেলের মত পারতো সময়ের প্রয়োজনকে এড়িয়ে যেতে ।সুলভ স্বচ্ছল নিষ্কন্টক নিরুপদ্রব জীবন কাটাতে পারতো অনায়াসে।বেঁচে থাকলে এখনো হয়ত সে দেখতে পারতো সাঁঝের আকাশ ,সন্ধ্যাতারা কিংবা দেশ বিদেশের অসংখ্য জানা অজানা নদী তীর।প্রিয়তম হতে পারতো কোন স্নিগ্ধ সুন্দরীর ।পিতা হতে পারতো কোন স্বাস্থ্যবান সন্তানের ।মেধাবী ছেলেটি হতে পারতো যেকোন কিছু।

 

 

যাদের রক্তের বিনিময়ে আজকেই ওই পতাকাটা উড়ছে স্বাধীন ভাবে অথচ এই পতাকার জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে ঘরের ছেলেরা আর কখনো ফিরে আসেনি ঘরে।ছেলেটি সেই দলেরই একজন,সেও ফিরে আসেনি কখনো। ফিরে আসেনি তার মত আরো অনেকেই ,তার সহযোদ্ধা আমাদের বিজয়গাঁথার স্বপ্ন সারথীরা।

 

 

ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ের সন্ধিক্ষণে যাঁর জন্ম,একাত্তরের নিবিড়
প্রশান্তিতে তাঁর চলে যাওয়া মাঝখানে দৃপ্ত জীবনের এক অনিমেষ অধ্যায়।আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতির পরিবর্তন হয়। আর ৪৪ বছর বয়সী বাংলাদেশ নামক ক্ষুদ্র একটা রাষ্ট্রে বসে আমরা স্বপ্ন দেখি আজ থেকে একশত চল্লিশ বছর পর আরেকজন রুমীর জন্ম হবে। মুক্তিযুদ্ধ ধারণ করে বেড়ে উঠা প্রতিটি বাংলাদেশী তরুণ বলে উঠে,আই আই ওয়ান্ট টু বি অ্যা রুমী।ক্র্যাক হেডেড রুমীরাই এক এক জন এক একটি বাংলাদেশ। এই রুমীরা বাংলার মাটিতে জন্মায়, বুকে একটি বাংলাদেশ নিয়ে হানাদার টর্চার সেলে জীবন দেয়। মাঝখানে রেখে যায় একটি দেশ, বাংলাদেশ। রুমীরা বুকের আগুন কে চোখের প্রতিজ্ঞা বানায়,অবাক পৃথিবী তাকিয়ে রয়।

 

 

যারা স্বর্গগত তারা এখনো জানে,

স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি
এসো স্বদেশ ব্রতের মহা দীক্ষা লভি
সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমি  

মুক্তির মন্দির সোপান তলে

লেখা আছে অশ্রুজলে ৷

 

৪৪৭জন ৪৪৭জন
0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ