স্বতঃসিদ্ধ নিয়মেই রাত নামে পৃথিবীতে। সকাল হয়। পশ্চিমাকাশে সূর্যের হেলে পড়ার সুবাদে অবসান হয় দুপুরের। প্রতিবেশে জন্ম নেয় বিকেল। কিন্তু সব বিকেলই তো এক রকম নয়! আবহাওয়ার ভিন্নতা ছাড়াও কিছু কিছু বিকেল তো অবশ্যই সমুজ্জ্বল অনন্য মহিমায়, উদ্ভাসিত ব্যতিক্রমী দ্যোতনায়! হিমেল হাওয়া-মাখা শীতের বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের কথা মনে হয় আমাদের। কেমন ছিল বিজয় দিনের অসাধারণ সেই বিকেলটি?
বিকেলটি নিশ্চিতভাবেই স্বর্গীয় মত্ততায় পূর্ণ ছিল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে যে স্থানটি আজ প্রতিষ্ঠিত ঢাকায়, সেই স্থানটি তখন ছিল রমনা রেসকোর্স ময়দানের অবিভক্ত অংশ। ঢাকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত সেই ময়দান লোকে লোকারণ্য ছিল সে বিকেলে। মুক্তিকামী জনতার মুহুর্মুহু চিৎকারে মুখর ছিল ময়দানের চারপাশ। ঐতিহাসিক এক অনুষ্ঠানের অংশ হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় উৎকণ্ঠার প্রহর গুনছিল উপস্থিত বাঙালিরা। ঘড়ির কাঁটা চারটা অতিক্রম করল। অতিক্রান্ত হলো আরও কিছু সময়। ময়দানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষের উল্লাস প্রবল হলো হঠাৎ! কেন? তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে একটা গাড়িবহর এসে থামল ময়দানের প্রবেশপথে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সামরিক কমান্ডের অধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরাকে নিয়ে সেই গাড়িবহর থেকে নেমে এলেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তাঁদের দুজনকে অনুসরণ করে ময়দানের মাটিতে পা রাখলেন ভান্তি অরোরা, এয়ার মার্শাল দেওয়ান, ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগত সিং, উইং কমান্ডার এ কে খন্দকারসহ আরও অনেকে। হ্যাঁ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নিদারুণভাবে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। সামরিক রীতি অনুযায়ী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল গার্ড অব অনার প্রদান করল বিজয়ী দলের অধিনায়ককে। অন্যদিকে বিজয়ী সেনাদলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়োজিত হলো বিজিত দলের সদস্যদের নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে। গার্ড অব অনার গ্রহণ করে ছোট্ট একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন অরোরা ও নিয়াজি। পাশাপাশি বসলেন তাঁরা। টেবিলের ওপর রাখা হলো একটি মুদ্রিত কাগজ।
‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব সারেন্ডার’ বা ‘আত্মসমর্পণের দলিল’ শিরোনামে মাত্র তিনটি অনুচ্ছেদে যে বাক্যগুলো সন্নিবেশিত সেই কাগজটিতে, বঙ্গানুবাদে তার রূপ দাঁড়ায় অনেকটা এমন:
‘পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সব সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণে স্বীকৃত হচ্ছেন। এই আত্মসমর্পণ পাকিস্তানের সব সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী এবং আধাসামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এসব বাহিনীর সবাই—যারা যেখানে আছে, সেখানকার নিকটস্থ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ ও সব অস্ত্র সমর্পণ করবে।
‘এই দলিল স্বাক্ষরের সময় থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীনস্থ হবে। নির্দেশের অবাধ্যতা আত্মসমর্পণের শর্ত ভঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং যুদ্ধের স্বীকৃত ও প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গৃহীত হবে। যদি আত্মসমর্পণের কোনো শর্তের অর্থ বা ব্যাখ্যা সম্পর্কে বিতর্ক দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এই আশ্বাস প্রদান করছেন যে আত্মসমর্পণকারী প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি জেনেভা কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী একজন সৈনিকের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করা হবে এবং তিনি আত্মসমর্পণকারী সব সামরিক ও আধাসামরিক ব্যক্তির নিরাপত্তা ও সুব্যবস্থার অঙ্গীকার প্রদান করছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীনস্থ সেনাবাহিনী সব বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের নিরাপত্তা প্রদান করবে।’
আত্মসমপর্ণের দলিলে সন্নিবেশিত বাক্যগুলো সুলিখিত হলেও নিয়াজির মতো একজন সেনা অধিনায়কের জন্য ভীষণ অপমানজনক। কিন্তু কিছুই করার নেই তাঁর! কলম তুলে নিলেন। স্বাক্ষর করলেন দলিলের নিচের অংশের ডান দিকের নির্ধারিত স্থানে। বাঁ দিকে স্বাক্ষর করলেন অরোরা। তারপর নিয়াজি তাঁর কাঁধ থেকে এপালেট (সেনা অধিনায়কের সম্মানসূচক ব্যাজ) খুলে দিলেন; ল্যানিয়ার্ডসহ (ছোট্ট দড়িবিশেষ) পয়েন্ট থ্রি এইট ক্যালিবারের রিভলবারটি তুলে দিলেন জগজিৎ সিং অরোরার হাতে। অস্ত্রসমর্পণের এই দৃশ্য অবলোকন করে অগণিত বাঙালি আনন্দে আত্মহারা হলো। আজ থেকে ৪৪ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সেই ব্যতিক্রমধর্মী বিকেলে শতাধিক দেশি-বিদেশি সংবাদকর্মীর উপস্থিতিতে সুসম্পন্ন হলো পাকিস্তানি বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ।
কৃতজ্ঞতা: নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, মাসুদুল হক
ছবি: সংগৃহীত
১৬টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
৪৪ বছর আগের দৃশ্য চোখের সামনে তুলে আনলেন। আর তা যেনো দেখলাম জীবন্তভাবে।
বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। -{@
দীপংকর চন্দ
অনেক অনেক ধন্যবাদ নীলাঞ্জনা নীলা।
শুভকামনা অনিঃশেষ।
বিজয়ের শুভেচ্ছা জানবেন।
ভালো থাকবেন। সবসময়।
নীলাঞ্জনা নীলা
🙂 -{@
দীপংকর চন্দ
শুভকামনা পুনরায়। অনেক।
জিসান শা ইকরাম
তথ্য ভিত্তিক পোষ্ট এর জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
বিজয়ের শুভেচ্ছা নিন -{@
দীপংকর চন্দ
ধন্যবাদ আপনার জন্যও প্রত্যুত্তরে।
বিজয়ের শুভেচ্ছা জানবেন।
অনিঃশেষ শুভকামনা।
ভালো থাকবেন। সবসময়। অনেক।
নূরু
দীপংকর দা,
এখানে আপনাকে
পেয়ে খুব ভালো লাগছে।
বিজয়ের শুভেচ্ছা নিন -{@
দীপংকর চন্দ
আমারও অনেক ভালো লাগছে নূরু ভাই আপনাকে দেখে।
আশাকরি আপনার তথ্যবহুল লেখা পঠনে বারবার উপকৃত হবো আমরা।
অনিঃশেষ শুভকামনা জানবেন ভাই।
ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।
বিজয়ের শুভেচ্ছা।
ভোরের শিশির
আপনার প্রতিটি শব্দে দেখতে পেলাম সেই দৃশ্যটি। বিজয়ে শুভেচ্ছা দাদা -{@
দীপংকর চন্দ
অনেক অনেক ধন্যবাদ নীতেশ দা।
ক্ষমাপ্রার্থণা অনিয়মিত উপস্থিতির জন্য।
আমার শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ।
বিজয়ের শুভেচ্ছাসহ ভালো থাকুন, এই প্রত্যাশা থাকছে।
ভোরের শিশির
আমি নিজেও অনিয়মিত বেশ কিছুদিন হতেই… আশা করছি আপনাদের মাঝে দ্রুতই ফিরতে পারবো।
শুভেচ্ছা দাদা। -{@
দীপংকর চন্দ
যখন যেখানে থাকুন, ভালো থাকুন- এই প্রার্থণা থাকছে।
শুভকামনা এবং শুভকামনা।
অপার্থিব
নিয়াজীকে আত্ন সমর্পণ করাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিলেন ভারতীয় জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব। নিয়াজী আত্ন সমর্পণে রাজী ছিল না তার ইচ্ছে ছিল যুদ্ধবিরতি করা। কিন্ত জ্যাকব কৌশল খাটিয়ে নিয়াজীকে আত্ন সমর্পণে বাধ্য করেছিলেন । ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারনে জ্যাকব তার প্রাপ্য পুরষ্কার পান নি। তার প্রসঙ্গটি লেখায় আসা উচিত ছিল।
দীপংকর চন্দ
শুভকামনা অনিঃশেষ।
জ্যাকব অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান সুদক্ষ সমরবিদ। তাঁঁর অবদান, তাঁঁর প্রসঙ্গ, তাঁঁর কৌশলী পদক্ষেপ নিয়ে হয়তো সময় সুযোগ মতো ভিন্ন কিছু কথা লেখার চেষ্টা থাকবে।
এখানে সামান্য বর্ণনায় একটি স্বর্গীয় বিকেলকে ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা ছিলো।
আপনাদের অজানা কিছুই নয়, জানা কথাগুলোই বারবার বলার চেষ্টা শুধু।
শুভকামনা পুনরায়।
ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।
বিজয়ের শুভেচ্ছা।
শুন্য শুন্যালয়
শতশত বার এদিনটির কথা পড়লেও তৃপ্ত হবেনা মন। আরো একবার ফিরে নিয়ে গেলেন সেই বিকেলে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে দীপংকর।
দীপংকর চন্দ
অনেক অনেক ধন্যবাদ শূন্য শুন্যালয়।
কৃতজ্ঞতা জানবেন উপস্থিতিতে।
জানবেন শুভকামনা। অনিঃশেষ।
উত্তর প্রদানের দীর্ঘ বিলম্বের জন্য ক্ষমাপ্রার্থণা থাকছেই।
ক্ষমাপ্রার্থণা পুনরায়।