একতলা শান্ত ছিমছাম সাদা বাড়ীটার সামনে ছোট্ট একফালি বাগানে পুরানো আমলের ইজি চেয়ারে অর্ধশায়িত নন্দিতা হক’ উদাসিন দৃষ্টি মেলেছে শরতের মেঘমুক্ত স্বচ্ছ সীমাহীন দিগন্তে। আজকাল প্রায় প্রতিটি দিনই সকল কাজের ক্লান্তিতে বড় হিসেব করে পাওয়া বিকেলটা এমনি করেই সন্ধ্যায় উৎরিয়ে যায় এই আকাশচারিতায় । সিমাহীন নিলাভ শামিয়ানার অদৃশ্য হাতছানির ডাক উপেক্ষা করতে পারে না কিছুতেই । নন্দিতা জানে আকাশ মানে এক ওজানা রহস্যাবৃত্ত গভীরতা , এক অনন্ত অসীম প্রসারিত শুন্যতা এবং নিস্তব্ধতার ধূমায়িত পর্দা । অগুনতি কালের সেই শুরু থেকে কল্পনার অবসান ঘটিয়ে যেখানে জীবন এবং মৃত্যুর অলঙ্ঘ্য নির্দেশের বসবাস।কোথায় যেন এক অদ্ভুত সাযুস্য খুঁজে পায় আকাশের গভীরতা ও নিজ ব্যক্তিত্ব এবং জীবন প্রবাহে ।ঋতুভেদে ঐ নীলাকাশের পরিবর্তনের মত, সুখদুঃখের সংমিশ্রিত ঘটানাবহুল জীবনে ,ব্যাক্তিত্তের প্রগাঢ়তা দৃঢ় হয়েছে অনেকখানি । ঠিক যেমন ঋতু পরিবর্তনে আকাশের আবেদন আরো গাঢ় হয় মানুষের কাছে । আকাশ আর মানুষ একাত্ম হয়ে পরে। জীবনের একটা তাৎপর্য খুজতে চেস্টা করে ও। অনেক ভেবেছে নন্দিতা, জীবন মানে কি শুধুই স্বল্পকালীন স্পন্দিত প্রাণে কিছু উপকরণ এবং মিথ্যে আচার বিচারের আয়োজন ‘ক্ষণভঙ্গুর উৎসব’।জীবন মানে কি শুধু শুন্য, শুধুই শুন্যতা ? অপরিসীম শুন্যতা বোধই ওর কাছে জীবন এবং আকাশকে করেছে ঘনিস্ট আলিঙ্গনাবদ্ধ । বয়সের সীমারেখায় সাধারণ হিসাবে তিন চতুর্থাংশ অতিক্রমের সন্ধি লগ্নে বড় বেশি শান্ত, বড় বেশি নিরব হয়ে পড়েছে ও । জাগতিক সবকিছু পিছনে ফেলে আকাশ আর নন্দিতা একাত্ম হয়ে পড়েছে যেন ।বয়সের সীমারেখায় সাদামাটা হিসাবে দুই-তৃতীয়াংশ অতিক্রমের সন্ধিলগ্নে বড় বেশি শান্ত, বড় বেশি নীরব হয়ে পড়েছে ও। জাগতিক সবকিছুকে পিছনে ফেলে আকাশ আর নন্দিতা একাত্ম হয়ে পড়ে যেন।
আজ অবসর গ্রহণের পঞ্চম দিন ।নিয়মবাধা চাকুরী থেকে অবসর পেলেও নিষ্ক্রিয় থাকা ওর স্বভাববিরুদ্ধ আর তাই আজ দু’বছর হল চাকুরীর ফাঁকে অনাথ অসহায় এবং অল্পবয়স্ক মেয়েদের স্বনির্ভর করে তোলার জন্য নিজের ব্যক্তি সীমিত সাধ্যের মধ্যে একটি হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। আপাততঃ একটি ভাড়া বাড়ির ফ্লাটে সকল কর্মকাণ্ড চলছে । ভেবে রেখেছে পেনসনের টাকাগুলো পেলে নিজস্ব একটুকরো জমিতে চালা তুলে প্রতিষ্ঠানটির একটি স্থায়ী ভীত করে দিতে পারবে । তারই প্রচেষ্টায় পেন্সনের না’নাবিধ ভাতাগুলি একটু তাড়াতাড়ি পাবার জন্য অফিস পাড়ায় ছুটোছুটি করতে হচ্ছে ।আজও তাই বের হয়েছিল, ফিরতে ফিরতে সাড়ে তিনটে বেজে গিয়েছিল।
সারাদিনের ক্লান্তি মোচনে কেবলমাত্র গোসল সেরে বেড রুমে ঢুকেছে নন্দিতা, ল্যান্ড কানেকশনটা তখনই বেজে উঠলো । নিজেই ধরেছিল ফোন , বাসায় উপস্থিত একমাত্র কাজের কাজের মেয়েটা তখন খাবার টেবিল সাজাতে ব্যস্ত।
প্রায় ত্রিশটি বছর অতিক্রান্ত , শুধু কণ্ঠস্বরে কি বাল্যবন্ধুকে চেনা যায় ? তাও যার সাথে ত্রিশ বছরে কোন সংযোগ নেই। ও পাশ থেকে আত্মপরিচয় দিতেই ভয় আর বিহ্বলতা ওর আত্মবিস্মৃত জীবন স্পন্দনকে প্রায় থমকে দিয়েছিল যেন। ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তায় সবাভাবিক কথার ধারা বাহিকতা এমনভাবে বজায় রেখেছিল যেন, গত বিশ বছর ধরে প্রায়ই এমন বাক্যালাপ হয়ে থাকে । হু , ত্রিরিশটি বছর পার হয়ে গেছে, তার বয়স এখন ত্রিরিশ বছর হবার কথা । কেমন আছে সে, কি করে এখন ? কেমন হয়েছে সে ? দেখতে কার মত ? নাহ, একবারও তার কথা জানতে চায়নি নন্দিতা ।
হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে প্রশ্ন করে,
-হ্যালো, নন্দিতা হক আছেন ?
-জী বলছি , কে বলছেন ? ওপাশে একটু স্মিতহাসি যেন ছুয়ে গেল মন ।উত্তর এল,
-আমি লন্ডনের জাহেদ বলছি, এখন ঢাকায় । তিনদিন হল এসেছি ,কেমন আছ ননী?
একটা শীতল সরীসৃপ যেন বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। অজানা ভয়ে শুকিয়ে এল গলা । কোনরকম উত্তর দিল,
-তাই, কোথায় উঠেছ তুমি ?
-আমার এক বোনের বাসায়। একটা বিশেষ কাজে এসেছি । স্বভাবসুলভ প্রশ্ন করে নন্দিতা,
-কি কাজ ?
-তোমার সাথে দেখা হওয়া দরকার, জরুরী কথা আছে।অনেক কস্ট হয়েছে তোমার নম্বর খুঁজে পেতে ।কখন সময় হবে তোমার? একটা অজানা আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে যায় । শব্দ যেন আর বের হয় না ।
পরিপূর্ণতার ডালি সাজিয়ে যে মহিলাটি স্বনামধন্যা লেখিকা,সম্মানিতা এবং সমাজ সেবিকা । তার এক কলঙ্কময় অতীত আয়নার মত সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখানে সদ্য সমাপ্ত বিশ্ববিদ্যালইয়ের উচ্চ ডিগ্রী প্রাপ্ত তেইশের এক শিক্ষিত তরুণী আঁচল উড়িয়ে দাড়ায় । ইংরেজীতে অনার্স আর মাস্টার্স করা নন্দিতা একটি বিদেশি ফার্মে এসিস্ট্যান্ট কমিনিউকেশন অফিসার হিসাবে যোগদান করে। কেবল প্রাপ্ত সার্টিফিকেট,
শিক্ষা সমাপ্ত নতুন জীবন, উপরন্তু চাকরী তাও বিদেশি এনজিওতে । স্বাভাবিক ভাবেই খুব সচেতন হয়ে উঠে, তখনি ঠিক করে খুউব মন দিয়ে কাজ করবে , সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ গড়বে নিজের।যা ভেবেছিল তাই করছিল, যদিও বাবামা খুব আপত্তি করতেন, বলতেন বিয়ে করার জন্য । না এমন নয় যে বিয়েতে আপত্তি ছিল ওর , মোটেও তা নয় । আসলে মনের মাঝে কল্পনায় যার মূর্তি ছিল ঘুমিয়ে, তেমন কাউকে মিলছিল না। সময় নিচ্ছিল তাকে খুজে বের করতে ।কিন্তু সত্যি বলতে কি বিয়ের ব্যপারটি কখনোই ওকে খুব নাড়া দেউ নি আর তাই তেমন করে অবসরেও কাউকে খোঁজার কথা মনে পড়েনি । বন্ধুবান্ধবরা বলতো বটে কিন্তু ওই পর্যন্তই । এই বলাবলি আর হাসি ঠাট্টার মধ্যে দিয়েই দেখতে দেখতে কখন যে তিনটি বছর পেড়িয়ে গেল ততদিনে নন্দিতা তখন পুরোদস্তর কমিউনিকেশন অফিসার। বেশ ভাল একটা বেতন পায়, বিদেশি কোম্পানি সুযোগ সুবিধাও তুলনামূলক অনেক বেশি ।নিজের কাজ আর যোগ্যতা দিয়ে একটা অফিসে একটা নিজস্ব ইমেজ করে নিয়েছে ইতিমধ্যে।
এরই মাঝে ওদের কোপানীর হেড অফিস থেকে মানে আমেরিকা থেকে একজন অল্প বয়স্ক তরুন এল কমিউনেকেশন ডিরেক্টর হিসাবে । সাদা চামড়ার আয়ান ব্রুক্স প্রথম নজরেই সকলের নজর কেরে নেয়, উন্নত ব্যাবহার এবং সুন্দর চেহারার জন্য । মোটেও বস সুলভ ব্যাবহার নয় আয়ানের ।অল্প সময়েই সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে যায় । আর দশজন আমারিকানের মত নাক উঁচু নয় ওর।
নন্দিতার সাথেও কাজে অকাজে বেশ একটা ভাল সমঝোতার সম্পর্ক গরে উঠে তরুন অবিবাহিত বসের সাথে ।আয়ান আর নন্দিতা বেশ ভাল বন্ধু একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না ।অফিসের কাজে শুধু ঢাকা নয় ঢাকার বাইরেও একসাথে যাতায়াত করে, একই হোটেলে পাশাপাশি থাকে কিন্তু কখনো তা আচরনের সীমাকে নিয়ে নয় । আয়ানও বাংলাদেশের সমাজ সংস্কৃতি সম্পরকে মোটামুটি জ্ঞাত বলেই মনে হয় ।অফিসের গন্ডি পেরিয়ে এই যে বন্ধুত্বকে শুধুই নির্মল এবং পরিচ্ছন্ন বলেই জানে সকলে।
এদিকে নিজে সিন্ধান্ত নিতে না পারায় বাবামা আর অপেক্ষা করতে নারাজ, ছেলে দেখতে শুরু করেছেন তারা, নন্দিতাও কিছু বলেনি । স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, অনেক হয়েছে, আর নয় এবার তাদের কথাই শেষ কথা । ভাগ্য কি নির্ধারণ এমনি যেন মেনে নিয়েছে ।
ডিসেম্বর মাস, খুউব ঠাণ্ডা পড়েছে। হিমালয়ের বুক চিড়ে শীতল এক প্রাবাহ ধেয়ে আসছে , দিনগুলো কেমন ধুয়াসাচ্ছন্ন । পথে ঘাটে গরীব মানুষের ভীষণ কস্ট ।দেশের উত্তরাংশে প্রতিদিন ঠান্ডায় জমে শিশু আর বুড়ো মানুষের দু, চারজনের খব পায় ওরা । অফিস সিদ্ধান্ত নেয় ওরা রংপুর ,পঞ্চগড়, নীলফামারীতে টিম পাঠাবে শীত পীড়িত দরিদ্র মানুষের সাহায্যে । দুটো টিম, পাচ হাজার কম্বল, পাঁচশ তাবু নিয়ে ওদের তিনজনের টিম রংপুর গেল । আয়ান, নন্দিতা আর রিপন নামের এক অফিস বেয়ারা । সারাদিন ওরা স্থানীয় অন্যান্য এনজিওর সাথে মিটিং এবং পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে রাতে কম্বল বিতরনে বের হল । আজো ভুলেনি নন্দিতা মানুষের সেই অমানবিক জীবন এবং কস্টের নির্মমতা, বিশেষ করে শিশু আর বয়স্কদের । সেই রাতে হোটেলে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়ে নন্দিতা , অনভস্থ ঠান্ডায় একেবারে কাতর হয়ে পড়ে। গরম গরম চা কফি খেয়েও কোন লাভ হয় না।বুক ধরে আসে, শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম প্রায় ।উপায় না দেখে আয়ানের রুমে ফোন করে । ছুটে আসে আয়ান , সব দেখে কিছুটা হকচকিত হলেও মুহূর্তে সাম্লে নেয় নিজেকে । ছুটে যায় নিজের কামরায়, একটা গ্লাসে লাল সরবতের মত নিয়ে আসে । খেতে দেয় নন্দিতাকে, বলে
–এটা খেয়ে নাও, ঠিক হয়ে যাবে এখনি । এটা ককটেল, এলকোহল নয় । পারলে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলে ও। ধীরে ধীরে গলাধকরন করে সবটুকু । ওকে জড়িয়ে ধরে আয়ান, নিজের শরীরের সবটুকু উত্তাপ ছড়িয়ে দিতে চায় ওকে । আস্তে আস্তে মিনিট পনের বাদে একটু যেন উন্নতি হতে থাকে ও। ঘটনার স্বাভাবিকতায় আয়ান ওকে বুকের ভিতর টেনে নেয়। আস্তে আস্তে কানের কাছে মুখ এনে বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।চেতনা নাকি অবচেতনা আজো ঠিক বলতে পারবেনা নন্দিতা, সেদিন এক সময় ওদের দুটো দেহ কম্বলের নিচে আদিম উষ্ণতায় এক হয়ে যায় ।
কখন যে আয়ান নিজের রুমে ফিরে যায়, তাও বলতে পারবে না ও। কিন্তু যখন ওর সম্পূর্ণ বোধশক্তি আপনাতে ফিরে আসে, তখন আর অবশিষ্ট বলে কিছু ছিল না ।লজ্জা ঘৃণায় মরমে মরে যাচ্ছিল নন্দিতা। এ সে কি করল? কি করবে এখন ? কি করে মুখ দেখাবে বাবামাকে এবং আর সবাইকে। হতভম্ব হয়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ। ঘ্রিনায় নিজেকে অসুচি মনে হয় খুউব। বাথরুমে গিজার চালিয়ে দেয়, অনেক সময় নিয়ে গোসল করে। কিছুতেই যেন শরীরের পঙ্কিলতা আর ধুয়ে যায় না ।শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছেত আছেই । কে বলবে এই মেয়েটা কয়েক প্রহর আগে ঠাণ্ডায় মরতে বসেছিল।
অনেক আগেই সকাল হয়ে গেছে। গসল সেরে বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে গুটিয়ে আছে নন্দিতা । সকল চিন্তাভাবনা সবকিছু যেন বরফ হয়ে গলে পড়ছে দুচোখ বেয়ে। এখন কি করবে ও ? নাকি আত্মহত্যাই একমাত্র পথ এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার । বেশ বুঝতে পারছে এখন মানুষ কেন এবং কখন আত্মহত্যা করে । সমস্ত পৃথিবী আতিপাতি করে খুজে যখন এমন একটা লতাপাতাও খুঁজে পায়না, যাকে জড়িয়ে ধরে একটু আহস বা সান্তনা পেতে পারে, বোধকরি তখনই মানুষ আর বাচতে চায় না । কোন মুখে, কার কাছে মুখ খুলবে ও। যাকেই বলুক, সবাই বলবে আয়ানকে বিয়ে করতে ।তা হলে ওর উচিত আয়ানকে বিয়ে করা ? না’কি আয়ান ওকে বিয়ে করবে ? হয়ত করবে , বলতে দোষ কোথায় ?
ভাবতে না ভাবতে, দরজায় টোকা । ভাবে বেয়ারা বোধকরি সকালের পেপার দিতে এসেছে । দরোজা খুলতেই সামনে মূর্তিমান আয়ান, সরে দাড়ায় নন্দিতা । ভিতরে ঢোকে আয়ান । দরোজা বন্ধ করে ফিরে আসে নন্দিতা । চোখে বাধহীন অশ্রু মুখটা নিচু করে ফিরে যায় বিছানার পাশে।
আয়ান জড়িয়ে ধরতে চায়, এক ঝটকায় ওর হাতটা সরিয়ে দেয়। হতচকিত আমেরিকান যুবক বোধকরি সামান্য সময় বাংলাদেশের সামাজিক পটভূমি বুঝতে । এবার বন্ধুর মত এগিয়ে আসে । বঝাতে চায়, দু’জন পরিপূর্ণ মানুষ একসাথে থাকলে, উপরন্তু তাদের মধ্যে ভাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকলে এমনটা একদিন কোন এক্সময় হতেই পারে। এটাকে এত বড় করে দেখার কি আছে । চিৎকার করতে ইচ্ছে করে ওর। বলতে ইচ্ছে করে এটা তোমার দেশ না, আমিও কন আমেরিকান মেয়ে নই । আমার আজন্ম সংস্কার আমাকে আমার সামাজিক, মানসিক একটা দর্শন তৈরি করে দিয়েছে, তার মুল্য অনেক এবং তমার থেকে ভিন্ন। কিন্তু না স্থির হইয় ও, এবার আস্তে আস্তে আয়ানকে বোঝাতে চেস্টা করে । কিন্তু না , আমারিকান আয়ান এটাকে কোন ভিন্নতর মাত্রায় গ্রহন করতে রাজী নয় । ওর মতে মানুষের অন্যান্য চাহিদার মত শারীরিক চাহিদাও একটি । তারপর দুজনের কেউ অপ্রাপ্ত বয়স্ক নয়, কাজেই বিশেষ মুহূর্তে এমনটা হতেই পারে। এমন ব্যাখ্যার পর কি আর বিয়ের কথা বলা যায় ? চুপ করে যায় নন্দিতা, আর কথা না বাড়িয়ে সেদিনই ফিরে আসে ঢাকায় ।
বাসায় পা রাখতেই সবাক হতবাক, উপরন্তু চোখে কালি পড়া উদ্ভ্রান্ত এই চেহারা । একশএকটা প্রশ্ন। বাবামা বাদ দিয়ে ছোট বোন , ভাইয়া সবাই জানতে চায় , ‘কি হয়েছে ওর’ ।
প্রচণ্ড শীত আর শীতে অসুস্থতার কথা বলে আপাততঃ রেহাই পায় নন্দিতা , কিন্তু নিজের কাছ থেকে লুকায় কি করে ? পৃথিবীতে সব থেকে কঠিন কাজ নিজের সাথে মিথ্যে বলা , নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানো । ক’দিন অফিস যায় না ও , একা একা থাকে, আগের সেই চিরচেনা উচ্ছলতা উধাও। বাবামা চিন্তিত , তারাও হয়রান, কি হল তাদের উচ্ছল হাসিখুসি মেয়েটির।
এক সপ্তাহ প্রে অফিসে আসে নন্দিতা । খুব অবাক হয়, যখন দেখে আয়ান কি সুন্দর অফিস্তাকে ম্যানেজ করে ফেলেছে । সবাই জেনেছে প্রচণ্ড শীতে নন্দিতার কোল্ড এটাক্ট হয়েছিল, তাই ওর রেস্টের প্রয়োজন । সবাই হ্যালো হাই করে জিজ্ঞেস করে , কেমন আছে এখন? পুরোপুরি সুস্থ না হয়ে থাকলে আরও ছুটি নিতে পারে। দায়সারা গছে হু, হা করে এড়িয়ে যায় । অথচ কি করে জানবে সবাই, সবার অলক্ষ্যে পালাতে চায় নন্দিতা, আর তাই দুহাতে আতিপাতি করে খুঁজছে পালানোর ঠিকানা।
আগের মত আর আয়ানের সাথে কথা হয় না, হয়না গল্পচ্ছলে হেসে কুটিকুটি হওয়া।তবে কাজ উপলক্ষ্যে এক আধবার দেখা হয়, স্মান্য কথাবার্তাও হয়। পনের দিন পার না হতেই, বাচার একটা আশা পেয়ে যায় নন্দিতা ।ইউ কে এবং কানাডার এর বেশ কয়েকটি ইউনিভারসিটিতে আবেদন করেছিল অনলাইনে । সমস্ত কাগজপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিল, আজ তা র উত্তর পেয়েছে । ওকে ওরা স্কলারশিপের সুবিধা দে আপাততঃ ৪০% পরে রেজাল্ট ভাল হলে ১০০%। ও ইচ্ছে করলে সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে আগামী সেশন ধরতে পারে। ।তিন বছরের বেশি চাকুরি করছে, একটা পয়সাও বাবামাকে দিতে হয় না, ব্যাঙ্কেই পড়ে আছে সব , কাজেই আর কোন দ্বিতীয় চিন্তা করে না। পালাতে চায় ও । পরিচিত পরিবেশ এবং নিজের কাছ থেকে পালাতে চায় ও। কাজেই আর কোন কথা নেই, একদম নিঃশব্দে সব কাগজপত্র, এবং প্রক্রিয়াগুলো সমাপ্ত করে নন্দিতা, পাসপোর্টে ভিসা লাগবার পর টিকিট কিনে ফেলে ও। এবার চাকরিটা ছাড়ার পালা । আজই চাকরীটা ছেড়ে দিল, একটু আগে নির্বাহী পরিচালকের কাছে পদত্যাগ পত্র দিয়ে এসেছে । উনি চেয়ারা বসিয়ে খুব স্নেহপ্রবণ হয়ে জানতে চেয়েছেন, কেন চাকরী ছাড়ছে , কি অসুবিধা হচ্ছে এখানে।
না জানিয়ে দিয়েছে ও, একটা স্কলারশিপ পেয়েছে কানাডায়, ব্রিটিশ কলম্বিয়ায়।এবার স্নাতকোত্তর ডিগ্রী একটা নিতে চায় । কাজেই সুযোগের অবহেলা করতে চায় না । যুক্তিসঙ্গত উপস্থাপনায় মেনে নেয় সবাই, অতএব আজ শেষ দিন।প্রায় সব সহকর্মীরাই এক এক করে দেখা করে গিয়েছে। আয়ানও এসেছিল আরও দুজনকে সাথে নিয়ে । ভাবটা এমন সেও আর দশজনের মত সম্পর্ক রাখে ওর সাথে।
বাসায় ফিরবার আগে একটু শপিং-এ গেল নন্দিতা । নিজের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক এবং খুঁটিনাটি অনেক কিছুই কিনে ফেলল। বাবামা , ভাইয়া আর ছোট বোনটার জন্য বেশ দাম দিয়ে কিছু কাপড়চোপড় কিনল। তাদের সবার পছন্দ কমবেশি জানা ্বেশি,কাজেই বেগ পেতে হলনা।
খুব হাসি হাসি মুখ নিয়ে বাসায় ফিরল নন্দিতা ।বাবামা , ভাইবোন সবার চোখে জিজ্ঞাসা , কতদিন পরে নন্দিতাকে হাসতে দেখল তারা । সবাইকে তাদের জন্য আনা উপহারগুলো দিয়ে খুব তৃপ্তি বোধ করলো নিজের কাছে । বাবামা কিছু একটা বলতে চাইছিলেন হয়ত , হয়ত বলতেন কেন খামোখা এতগুলো টাকা পয়সা নষ্ট করলো কিন্তুকি দরকার ছিল। কিন্তু না, অনেকদিন পর মেয়ের পরিবর্তনে তারাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চাইলেন।
রাতের খাবারের পর বাবামা যখন নিজেদের ঘরে কেবল শোবার আয়োজন করছেন, তখন পায়ে পায়ে ঢোকে নন্দিতা । বাবামাও অনেকদিন পর সহজ স্বাভাবিক নন্দিতাকে পেয়ে কলকল করে উঠেন । এই মুহূর্তের অপচয় করতে চায় না ও। খুব হিসেব কষে বাবামাকে উচ্চতর লেখাপড়ার কথা জানায় । শোনার সাথে সাথে মা ভেটো দিয়ে বসেন,
-না অনেক হয়েছে , পড়তে চাও পড়। বিয়ের পরে পড় । কোন আপত্তি নেই আমাদের।
কিন্তু তারা কি করে বুঝবেন ওকে যে আপাততঃ পালাতেই হবে, নিজের কাছ থেকে, সবার কাছে থেকে।তাছাড়া মাত্র আঠার মাসের কোর্স । যে করেই হউক অন্ততঃ অল্প কিছুদিনের জন্য পালাতে চায় কোন এক ভিন্ন পরিবেশে,সম্পূর্ণ অজানা অচেনা কোন জগতে ।অপরাধের বোঝাটা মন থেকে নামাতে চায় ও। ভাইয়াকে ডেকে আনে, যুক্তি দেয় কতশত। শেষতক , একটা আপোষে আসে, আপাততঃ পড়তে চলে যাবে কিন্তু বিয়ে ঠিক হলে, বা পাত্র পছন্দ হলে ছুটিতে এসে একটা কিছু ফাইনাল করবে।ব্যাস, এবার ও অনেক হালকা । আরও কুড়ি দিন বাকি ওর ফ্লাইটের । এর মধ্যে গুছিয়ে নিতে হবে সব।
কিন্তু বিধাতা অলক্ষ্যে হাসলেন । ক’দিন যেতে না যেতেই নন্দিতা বুঝতে পারল, ওর শরীরে একটা বিশাল পরিবরত্নের বীজ রোপিত হয়ে গেছে । এখন ! এখন কি করবে ও ? প্যাথলজি টেস্ট করে কনফার্ম হল । এবরশনের কথাও ভাবল কয়েকবার, কিন্তু কোন যুক্তিতর্কই বিশ্লেষণে সায় দিল না কিছুতেই ।শেষ বারের মত ছুটে গেল আয়ান ব্রুক্সের কাছে, জানাল তার ভ্রূণ পৃথিবীতে আসছে। একদম শান্ত চুপ করে শুনল, শুধু বলল, এবরশন করে ফেল । নন্দিতা ওর সিদ্ধান্ত জানাল,না তা কিছুতেই হবে না ।
অতিকষ্টে নানা বাহানা করে , নানা ছলনায় কেটে গেল কটা দিন। নির্ধারিত দিনে আর যেন তর সয়না ওর। একসময় বাংলাদেশের মাটি ছেড়ে উড়ে গেল তরেন্ট, কানাডায় । সেখানে দুই ঘণ্টার ট্রানজিট , দেড়দিনের দিন ব্রিটিশ কলম্বিয়া । এয়ারপোর্ট থেকে অনেক দূরে , সে পথও এক্সময় ফুরিয়ে গেল । হাযির হল, নির্ধারিত ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে।
সে এক নতুন জীবন , নতুন দেশ নতুন সবকিছু । পড়ালেখা এবং অন্য সবকিছুতে নিজেকে মানাতে কস্ট হয়নি নন্দিতার ,কিন্তু সারাক্ষণ কাঁটার মত খোঁচা দিত এই অবিবাহিত অবস্থায় অনাকাঙ্ক্ষিত মা হওয়া ।কিছুতেই যে এটাকে অতিক্রম করতে পারছিল না ও। তবুও সবকিছু ভুলে স্থিত হবার চেস্টায় আত্মনিয়োগ করলো ও।
কপাল ভাল ছিল ওর, একজন প্রবাসী বাঙালি জনাব জাহেদ আনয়ারকে পেল ওরই ডিপার্টমেন্টের ফ্যাকাল্টি হিসাবে। বাঙালি যখন দেশের বাইরে থাকে তখন সম্বভতঃ দেশকে খুব আত্মস্থ করে কাজেই একজন বাঙালি ছাত্রীর সাথে দ্রুত আন্তরিক সম্পর্ক হতে সময় লাগলো না । উপরন্তু জাহেদ সাহে বের স্ত্রী একেবারেই নির্জলা হাউস ওয়াইফ।নিঃসন্তান উনারা , অথচ বয়সও তেমন বেশি না। দু’জনেই চল্লিশের কাছাকাছি ।নন্দিতাকে জাহেদ স্যার একেবারে আপ্ন বোনের মত কাছে টেনে নিয়েছেন । মাত্র তিনমাসে ও যেন তাদের পরিবারের একজন হয়ে যায় ।ওদের মেশার মধ্যে কোন দূরত্ব নেই । জাহেদ স্যারের স্ত্রী মানে মালা ভাবী বুঝতেই পারে না ও অন্তসবত্তা । ও নিজেও কিছু বলে না, যদিও ভয়টা ওর মধ্যে পুরদস্তর রয়ে গেছে । এখন না হয় কেউ বুঝতে পারে না কিন্তু আর কদিন পর যখন দেহের পরিবর্তনগুলো প্রকট হবে তখন কি করবে ও । চিন্তা করে কোন কুল কিনিরা করতে পারে না । ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দেয় সমাধানের ভার । এদিকে ধাকার বাসায় বাবামাকে জাহিদ স্যার এবং মালা ভাবির কথা সব জানিয়েছে । তারাও খুব নিশ্চিত এমন একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ পেয়ে ।কয়েকবার ঢাকা থেকে কথাও বলেছেন জাহেদ স্যারের সাথে। মোটামুটি পড়াশুনার ব্যাস্ততা , জাহেদ স্যার ও ভাবির সাহচর্য এবং পড়াশুনায় পরখ্যে সাহায্যে ওর দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল একরকম ।শুধু সব ছাপিয়ে একটা চিন্তা অহরহ কুঁচিয়ে তোলে ওকে ।
ঠিক যেদিন চার মাস পূর্ণ হল, ইউনিভার্সিটিতে ক্লাসে ছিল ও । হটাত এডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিং থেকে ক্লাসে টেলিফোন এল । ফ্যাকাল্টি নিজেই ধরলেন । কথা শেষ করে নন্দিতার দিকে তাকিয়ে ওকে এখনি দেশে বাড়ীতে ফোন করতে বলল । ভীষণ ঘাবড়ে গেল ও। সবার আগে জাহেদ স্যারকে ফোন করলো কিন্তু তাকে পেলনা , তখন নিজেই দৌড়ে গেল মেইন বিল্ডিঙ্গে , ফন করলো বাসায় । মামাত ফোন ধরল, খুব আস্তে আস্তে কথা বলছে, গলাটা খুব ধরা ধরা লাগছে। ঢাকা থেকে জানতে চাইল , ও কেমন আছে, সব ভালত? নন্দিতা ভাল বলে জানতে চাইল কেন এই এমারজেন্সি ফোন করতে বলা, কি হয়েছে । না’নাভাবে সান্ত্বনার কথা বলার পর ওকে ব্যাতিব্যস্ত হতে নিষেধ করে। কথা চলাকালীন ছোটবোন নায়না ফোন ধরে,
-ননী আব্বু আর ভাইয়া নেই আপু, য়ামাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে ।গাড়ী এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে আজ দুপুরে মানিকগঞ্জ যাচ্ছিল আব্বা আর ভাইয়া।
আর শুনতে পারে না নন্দিতা, অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে । যখন জ্ঞান ফেরে তখন ও হাসপাতালে । পাশে মালা ভাবি, ভীষণ উদ্বিগ্ন মুখ ।খুব স্নেহভরে শান্তনা দেন এবং বুকে জড়িয়ে ধরেন । একটু পরে জাহেদ স্যার আসেন, তার মুখটাও উদ্বিগ্ন । তিনিও খুব স্নেহভরে, আদর মাখানো সান্তনা দেন । নন্দিতা ভাবে, কি হতে পারতো আর কি হল ওর জীবনে ? না চিৎকার করে কাঁদতে পারে না ও । হসপিটালের আর ওর সব দায়দায়িত্ব সব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন জাহিদ স্যার । ডিসচার্জ নিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে আসেন ওকে । ঠিক হল ও ঢাকায় আসবে, প্লেনের টিকেটের জন্য বুকিং দেয়া হল, কিন্তু ঢাকা থেকে মা নিজেই শোককে শকিতে পরিণত করে কথা বললেন। জানালেন এসে আর কি হবে, লাশের চেহারা খুব খারাপ, দুজনেই থেতলে গেছে। কেউ এমন ক্ষত বিক্ষত লাশ রাখতে চাইছে না , আজই কবর হয়ে যাবে । ও আর এতদূর কস্ট করে এসে এত ধকল সইবে কেন ! জাহিদ স্যারকে অনুরধ করলেন, ওর দিকে একটু বেশি খেয়াল রাখতে ।
জাহিদ স্যার আর মালা ভাবি এত বেশি আপন করে নিয়েছিলেন, যে পৃথিবীতে বাবামার সাথে যাদের কথা ওর সবার আগে মনে আসে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার সাথে তারা ওই দম্পত্তি ।
বেশক’টা দিন কেটে গেল, কেমন করে কেটে গেল তা যার উপর দিয়ে যায় সেই শুধু জানে । একটু স্থিত হয়ে মার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখল নন্দিতা, আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হল । বুঝতে বাকি রইল না, আর্থিক কস্ট না হলেও মা কত একা হয়ে গেলেন এবং আমৃত্যু এক দুঃসহ যন্ত্রণা সাথি করে বেচে রইলেন সংসারে । চাচা মামা ছিল , তারা আপাততঃ অভিভাবকের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাধে নিলেন । নন্দিতা পড়াশোনায় অনেক বেশি মন বসাতে চাইল ।
একটু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে যখন তখন জাহিদ স্যার আর মালা ভাবি ওকে নিয়ে রয়েল থিয়েটারে গেলেন । রাতে বাইরে খেলেন, একটা তুর্কই রেস্টুরেন্টে । বাসায় ফিরে খুব আড্ডায় মেতে উঠলেন । আজ প্রায় দশদিন এই বাসায় আছে ও, ইউনিভার্সিটি ওর ক্রাইসিস লিভ মঞ্জুর করেছে । কাজেই জাহেদ স্যার বলেছেন,আরও কটা দিন পর পড়াশুনায় যোগ দিতে।
রাতে যখন আড্ডা জমে উঠেছে তখন মালাভাবি জিজ্ঞাসা করলেন
– নন্দিনী, তুমি আমাদেরকে সব বলেছ কিন্তু তুমি যে বিয়ে করেছ তা কেন গোপন করলে? কি বলবে নন্দিনী ? হতবিহবল হয়ে তাকিয়ে থাকে উনাদের দিকে ।এটা কি ঠাট্টা না আর কিছু , বুঝতে চেস্টা করে । স্যার চুপচাপ সোফায় বসে মিটিমিটি হাসছেন।
– কি দেখছ ? ভাবছ আমরা জানলাম কি করে ! আরে মেয়ে না হয় গোপনেই করেছ, কিন্তু তাই বলে এত বড় কথাটা আমাদের কাছে লুকিয়ে রাখলে ? আমরা বুঝি তোমার আপনার নই ?সেদিন হাসপাতাল থেকে না বললেত আমরা জানেতেই পারতাম না ।
এবার যেন ভয় এবং লজ্জা ওর মাথা চেপে ধরে। ঘাড়টা নিচু হয়ে যায় আপনা আপনি। ঘাড় গুঁজে অঝোর ধারায় জল ঝরাতে থাকে নন্দিতা ।ডুকরে কেঁদে উঠে ও, একটু ভালবাসা একটু নিরাপদ আশ্রয়ের সংস্পর্শে বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মুখে ভেঙ্গে যায় ওর কঠিন আবরণ ।
এক এক করে সব খুলে বলে,এতটুকুও ফাঁক ফোঁকর না রেখে । না, এত ভাল দুজন মানুষের সাথে আর কোন ছলচাতুরী নয় । ওর যা হবার হবে । কি আর হবে এই মহামূল্যবান আশ্রয়টুকু না হয় চিরতরে হারিয়ে যাবে । মাত্র সাতাশ বছর বয়সে অনেক অনেক কিছুই হারিয়ে রিক্ত নিঃস্ব হতভাগ্য এই মেয়েটি ।হারাবার ভয় করে কি লাভ ? অন্তরীক্ষে যে একজন আছেন, সেই তিনি , তার ইচ্ছায় মর্জিতে সবার দাসত্ব । নয়ত কি অপরাধ ছিল নন্দিতার ?
কিন্তু অবাক কান্ড ! স্যার আর মালা ভাবি, এরা কি মানুষ ? না’কি মানুষ বেশি ফেরেশতা । উনারা ততধিক স্নেহভালবাসা নিয়ে এগিয়ে আসেন যেন । ঘৃণা বা তিরস্কার দুরের কথা , মায়া মাখানো মুখদুটি স্নিগ্ধ এক আলোর দিকে নিয়ে যায় ওকে ।
আরও চার মাস পর একটি ছেলে প্রসব করে নন্দিত।এতটুকু তুলতুলে ফরসা ছোট্ট একটা শিশু, মাথাভরতি একরাশ কাল ঘন চুল এবং বড় বড় দুটো মায়াময় চোখ , ঠিক যেন নন্দিতার মত।কে জানে কোথা হতে একরাশ ভালবাসা এসে ভর করে বুকের মাঝে । মালাভাবির ওখানেই ও থাকে, সেই আব্বার মৃত্যুর পর থেকেই। স্যারই সব ব্যাবস্থা, ইউনিভার্সিটির পারমিশন নিয়ে এসেছেন। দিনরাত ভাবিই বাচ্চাটি দেখভাল করেন, নন্দিতা পড়াশুনায় গভীর মনোযোগ দেয়।কেউ কি জানে ইচ্ছে করেই যেন নিজেকে একটু আলাদা করে রাখে নন্দিতা । মালা ভাবি বেশ আছেন, একটা খেলনা পেয়েছেন যেন । শুধু কি যত্ন আত্তি, ওর সমস্ত খরচ উনারাই করেন, প্রয়জেনর অবকাশ না রেখেই ।স্যারের সংসারে যে খুশির বন্যা বইছে । মালা ভাবি বাচ্চার নাম রেখেছে অনন্য, জন্মের সময়েই । বার্থ রেজিস্টারে তাই লেখা আছে। জাহিদ স্যার আর মালা ভাবির যত্ন আত্তির কারণে পরীক্ষায় সাফল্যের শীর্ষ তিন চার নম্বরে স্থান করে নেয় । একসময় ফাইনাল সেমিস্টার শেষ হয়ে গেল । নন্দিতা ভেবে রেখেছে রেজাল্ট হতেই দেশে ফিরে যাবে । হাতে এখন দিন পনের সময় আছে । আরও একটা জিনিষ ভেবে রেখেছে , যা এই মুহূর্তে কারো সাথে শেয়ার করতে চায় না। বার বার ভাবে , ঢাকায় মা আছে , আছে নায়না । ওদের প্রতি ওর এখন অনেক দায়িত্ব । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকায় যেয়ে ওদের পাশে দাড়াতে হবে।
আজ আবারো ওরা তিনজন, ভুল হল চারজন একসাথে বের হয়েছে ।যাবার আগে একটু এদিক ওদিক ঘুরে বেরানো । একটা অনেক বড় মলে এসেছে সবাই, নন্দিতা যাবার আগে মা আর নায়না এবং অন্যান্যদের জন্য কিছু কিনবে আজ । স্যার আর ভাবি এদিক ওদিক ঘুরে অনেক কিছু কিনলেন, দেখা হল না ওর । বাচ্চাতা একটা প্যারাএম্বুলেটরে নিয়ে মালা ভাবির শপিং স্টাইল দেখার মত । বুক্টা জুড়িয়ে গেল ওর।
আজ রেজাল্ট পেয়ে গেছে। পরশু ওর চলে যাবার দিন । না বাচ্চাটাকে ওর পাসপোর্টে ভুক্তি করেনি । আজ রাতে বসবে স্যার আর মালাভাবির সাথে।
যা ভাবা তাই করা, রাতে খাবারের পর নন্দিতা স্যার আর ভাবির সাথে রুমে ঢোকে , যদিও এমনটা ও প্রায়ই করে, কেননা অনন্যকে শুভরাত্রি জানাতে আসে । ওকে দেখে জাহিদ স্যার আর ভাবি যায়গা করে বসে । নন্দিতাও একটু সময় নেয় , কি ভাবে বলবে বুঝতে পারে না । কিন্তু না ওকে এই সাতাশ বছরের জীবনের সব চাইতে কঠিন কাজটি আজ করতে হবে , করতেই হবে। অনেক ভেবেছে ও । এটাই সবচেয়ে ভাল ব্যাবস্থা , এটাই মঙ্গলজনক । যে স্রষ্টার উপর ওর এত অভিমান, তার প্রতি,তার এই সহজ সমাধান সামনে রাখার জন্য অকাতরে ধন্যবাদ জানায় । এগিয়ে যায় ধীর পায়ে, ক্রডল থেকে ঘুমন্ত অনন্যকে তুলে আনে দুহাতে। এসে বসে একদম স্যার আর মালা ভাবির মাঝখানে । স্যারের হাত আর ভাবির হাতটা তুলে আনে নিজের দিকে । দুজনের হাতের উপর অনন্যকের তুলে দেয়। আস্তে আস্তে করে বলে,
– ভাবি জন্মের দিন থেকেই ও আপনাদের সন্তান। আমি শুধু ওর বায়লজিক্যাল মা। একটু ভেবে দেখুন না হলে আমার জীবনে এমন ঘটনা ঘটবে কেন ?আমি ই’বা আপনাদের এখানে কাছে আসব কেন । আমি পরশু চলে যাচ্ছি, আপনাদের আমানত আপনাদেরই থাকল , আমি এখন ফিরে যাব সেই নন্দিতা হয়ে যার জন্য মা আর নায়না অপেক্ষায় আছে ।
তারপর আরও উনত্রিশটি বছর কেটে গেছে।নন্দিতা মা আর বোনের পাশে মহীরুহ হয়ে দাড়িয়েছে । বিয়ে করতে চায়নি কিছুতেই , কিন্তু মায়ের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে আর না বলতে পারেনি । শেষতক একজনের কাছে নিজের অতীত খুলে দিয়ে ভালবেসেছিল, বিয়েও করেছিল । একটা মেয়ে আছে নন্দিতার , অনন্যা নাম রেখেছে ও। সেই মেয়ে এখন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে টিউটর , মাস কয়েক পড়ে অস্ট্রেলিয়া যাবে হায়ার স্টাডি করতে । ওর স্বামী কামাল হার্ট স্ট্রোক করে মারা গেছেন আরও দশ বছর আগে। এই বাড়ীটা ওর স্বামীর ।
জাহিদ স্যার , মালা ভাবি ভীষণ ভাল মানুষ আর ফিরে আসেননি দেশে । প্রথম দিকে যোগাযোগ রাখলেও ওর বিয়ের পর একদম প্রায় শুন্যতায় নামিয়ে এনেছিলেন। বেশ বুঝতে পারেন স্যারের এই দূরত্ব বজায় কেন । মা মারা গেছে তিন বছর । নায়না বাংলাদেশে নেই, বিয়ে করে ডালাসে চলে গেছে অনেকদিন, মাঝে মধ্যে দু’তিন বছর পর পর আসে বাংলাদেশে ।
সেই জাহিদ স্যার ফোন করেছিলেন, বলেছেন জরুরি কথা আছে । কি কথা আছে ওর সাথে ? ত্রিশ বছর পর আজ কি কথা থাকতে পারে নন্দিতার সাথে ? স্যার কি তবে তাকে কিছু বলেছেন ? সেকি তবে আজ তার মায়ের কাছে আত্মজের পরিচয় নিয়ে দাড়াতে চায় ? কি চায় সে ?
২৭টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
বেশ বড় গল্পটা পড়লাম মন দিয়ে।
কাহিনীটা ভালো এবং কষ্টের–
নন্দিতার মনের জোর ছিল বলেই এমনটা পেরেছে,সাধারন হলে অনেক আগেই পৃথিবী হতে চলে যেত।
গল্প কি এখানেই শেষ?নাকি আত্মজ পরিচয় নিয়ে এগিয়ে যাবে?
ভাল লেগেছে।
এত বড় গল্প দুটো পর্বে দিলে ভালো হয়-
ছোট একটু সমালোচনা করলাম।
পারভীন সুলতানা
অপূর্ব । আমি এর দ্বিতীয়টা পর্ব লিখব বলে হাত দিয়েছি । আমার আরেকটি গল্প ঠিক একিই ভাবে দ্বিতীয় পরবে লিখব ভাবছি। সমালোচনায় আত্মশুদ্ধি হবে, লেখা উন্নত হবে।
লীলাবতী
জাহিদ স্যারদের মত মানুষ আছেন বলেই পৃথিবীটা এখনো টিকে আছে।আপু জিসান ভাইয়ার সাথে একমত।এত ভালো একটি গল্প এত বড় হবার কারনে পাঠক এড়িয়েও যেতে পারেন। আপনি এই গল্পটিই দুই পর্বে দিন। আত্মজ পরিচয়-১, আত্মজ পরিচয়-২ এভাবে।আমরা যারা পাঠক সীমিত সময় নিয়ে আসি।এই সময়ে সবার লেখা পড়তে চাই।তাই লেখা গুলো ছোট হলে সবার জন্য উপকার হয়। -{@
পারভীন সুলতানা
বুঝলাম এখনো ভাল গল্প লেখক হতে পারিনি । আমার গল্প আপনাদের ধরে রাখে না । চেষ্টা থাকবে গল্প যতই বড় হউক , এক নিঃশ্বাসে পড়ার আকুতি যেন থাকে।
লীলাবতী
আমার কথা আপনি মনে হয় বুঝতে পারেননি।আপনি যেভাবে বললেন আমি কিন্তু তা বলিনি।আপনার গল্প অবশ্যই ভালো হয়েছে।
ধরুন আমি একজন পাঠক.৩০ মিনিট সময় আমি সোনেলায় থাকবো।এই ত্রিশ মিনিটে আমি সবার লেখা পড়তে চাই।একটি বড় লেখায় যদি আমার ১৫ মিনিট চলে যায়,অবশিষ্ট ১৫ মিনিটে আমি অন্য সবার লেখা পড়তে পারবো? সব লেখকই তো চান যে তাঁদের লেখাটি পাঠকগন পড়ুক। পাঠক যদি নিজে আবার লেখক হন,সেও তো চাইবে তার লেখাটি অন্য সবাই পড়বেন।
নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি আপু,বড় লেখা অনেকেই এরিয়ে যান।লেখাটি না পড়েই মন্তব্য করে চলে যান।
আমার পরামর্শ এই কারনে যে,আপনি ভাল লেখেন,আপনার লেখাগুলো যেন পাঠকগন পড়েন। শুভ ব্লগিং আপু -{@
পারভীন সুলতানা
ধুর ! আমি তেমন কিছু মনেই করিনি । আমি শুধু বুঝি যারা গল্প পড়তে ভালবাসেন তারা যদি একবার মজা পান না পরে উঠতে চান না ।
আমি একটু পুরানো মানুষ , খুব বিস্তারিত না করে লিখতে পারি না। আপনাকে প্নেক ধন্যবাদ।
লীলাবতী
আপু আমার উপর আবার রাগ করবেন না,তাহলে কিন্তু আমি কাঁদবো ;(
অনিকেত নন্দিনী
অদ্ভুত ঘোরলাগা আবিষ্টতা এখনো জড়িয়ে আছে।
গল্প চলুক এগিয়ে। অন্যদের মতো করেই বলছি, খন্ডে খন্ডে দিলে আরো পাঠকপ্রিয়তা পাবে মনে হয়।
পারভীন সুলতানা
জীবন থেকে নেয়া জীবনের গল্প , অনেক ধন্যবাদ ভালো লাগার জন্য । বুঝলাম এখনো ভাল গল্প লেখক হতে পারিনি । আমার গল্প আপনাদের ধরে রাখে না । চেষ্টা থাকবে গল্প যতই বড় হউক , এক নিঃশ্বাসে পড়ার আকুতি যেন থাকে।
সীমান্ত উন্মাদ
আপু আপনি গল্পটি পোষ্ট করার পরে আমি তিনভাগে গল্পটি পড়ে শেষ করলাম। আমার কাছে বেশ ভালোলেগেছে। বিশেষ করে নন্দিতার মানুষিক শক্তিটা। আর জাহিদ স্যার এবং মালা ভাবির কথা বললেন এই ধরনের মানুষ পৃথিবীতে আছেন বলেই শত কষ্ট আর হানাহানীর মাঝেও আমরা মানুষ বলে পরিচয় দিতে পারি।
আপনার জন্য শুভকামনা নিরন্তর। ভাল থাকবেন বেলা অবেলার গল্প গানে।
পারভীন সুলতানা
হু, আর কতকাল এরা শক্তিহীন থাকবে ? আমাদের সময় পেড়িয়ে এরা এখন আধুনিক পৃথিবীতে নতুন প্রজন্ম । আর কতকাল সমাজের বস্তাপচা বিধিনিয়মে সত্যের অপমৃত্যু ঘটবে।
নীলাঞ্জনা নীলা
পরের পর্বের অপেক্ষায়। এবং গভীর আবেগের সাথে।
পারভীন সুলতানা
ইনশাল্লাহ হতাশ হবেন না ।
সিকদার
চলুক লেখনী । সাথেই আছি ।
পারভীন সুলতানা
আমিও লিখেই যাচ্ছি, লেখাই এখন আমার বন্ধু ।
সঞ্জয় কুমার
সোনেলাতে স্বাগতম । লিখুন । জীবনের এমন বাস্তব গল্পই শুনতে চাই ।
পারভীন সুলতানা
গল্পত জীবনেরই কথা বলে তাই না ! জীবন ঘেঁষা না হলে সে আর গল্প হবে কেন ? অপেক্ষা করুন , আমি আসছি।
ব্লগার সজীব
বিকেলেই পড়েছি আপনার লেখা।অত্যন্ত ভালো লেগেছে।আর একটি পর্ব চাই আত্মজের কথা নিয়ে।সে কেমন আছে এসব নিয়ে।
পারভীন সুলতানা
সংসারে সবার চাহিদা মিটিয়ে তবেই লিখতে হয় । তবুও বলছি পাবেন, এখানেই পাবেন।
রাসেল হাসান
অর্ধেক পড়েছি বাকী অর্ধেক আরেকদিন পড়বো। ভালো লাগছে…
পারভীন সুলতানা
আশাকরি এরপর আর বাকিটা ফেলে রাখবেন না।
স্বপ্ন
লেখাটি বেশ বড়,তারপরেও পড়লাম।জাহিদ স্যার এর পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হলাম।আর একটি পর্ব করুন আপু।
পারভীন সুলতানা
জী , আপনার দাবি অবশ্যই গ্রহনীয় । পরিচয় পর্বটি আমি কেবল হাত দিয়েছি । দেখি ক’দিনে নিয়ে আস্তে পারি । রোজায় , নানাবিধ কাজে একদম কাহিল । সময় পেলেই লিখছি।
মেহেরী তাজ
খুব মন দিয়ে পুরো গল্পটা পড়েছি আপু। অনেক বড় লেখা। পর্ব করে দিতে পারতেন।
যাক অনেক ভালো লেগেছে।
পারভীন সুলতানা
এই গল্পটি আসলে তিন খন্ডের, এখানে প্রথম খন্ড । দ্বিতীয়টি আসবে অচিরেই এবং শেষে সমাপ্তি ।
শুন্য শুন্যালয়
এক নারীকে বিধাতা দুটো চরম বৈপরীত্য দিয়েছে। “মা” এ হচ্ছে নারীর সবচেয়ে বড় শক্তি, সবচেয়ে বড় দূর্বলতাও। মন দিয়ে পড়েছি গল্পটা আপু। আপনার ভাবনার বিস্তৃতি ব্যাপক। অপেক্ষা করছি পরের অংশটুকু জানার।
পারভীন সুলতানা
কোথায় যেন আপনার সাথে আমার উপলব্ধির মিল খুজে পাচ্ছি । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ । পাবেন অচিরেই আমি দ্বিতীয় পর্বটি পোষ্ট করবো আর সমাপ্তিটা একদম শেষে ।