১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদী জামাত-ই-ইসলামি নেতা রাজাকার দেলওয়ার হোসেন সাইদিকে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু আজ ফাঁসির সাজা মওকুব করে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিল বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট। ট্রাইব্যুনাল সাইদিকে ৬টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছিল সেই ছয়টির মধ্যে তিনটির ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বৈধ বলে জানিয়েছে শীর্ষ আদালত। হত্যাকাণ্ড, একাধিক ধর্ষণ ও বলপূর্বক হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তর-ইত্যাদি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলেও গণহত্যার অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছে সে।
হত্যাকাণ্ড, একাধিক ধর্ষণ ও বলপূর্বক হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তর-ইত্যাদি অভিযোগ প্রমানিত হলেও তাকে মৃত্যু দন্ড না দেয়ায় হতাশা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এটর্নী জেনারেল সহ স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির অনেক ব্যক্তিবর্গ এবং সংগঠন
আসুন দেখি তার বিরুদ্ধে কি কি অভিযোগঃ
অপরাধ-১: ১৯৭১ সালের ৪ মে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নেতৃত্বে পিরোজপুর সদর এলাকার মধ্য মাসিমপুর বাসস্ট্যান্ডের পেছনে ২০ জন নিরস্ত্র বাঙ্গালিকে গুলি করে হত্যা।
অপরাধ-২: ৪ মে সাঈদী ও তার দল পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে মাসিমপুর হিন্দুপাড়ায় লুট করেন এবং আগুন ধরিয়ে দেন। মানুষ পালাতে শুরু করলে সাঈদী ও তার দলের সদস্যরা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করলে ১৩ জন শহীদ হন।
অপরাধ-৩: ৪ মে সাঈদী পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে মাসিমপুর হিন্দুপাড়ায় মনীন্দ্রনাথ মিস্ত্রী ও সুরেশ চন্দ্র মণ্ডলের বাড়ি লুট এবং আগুন ধরিয়ে দেন।
অপরাধ-৪: ৪ মে সাঈদী তার রাজাকার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে ধোপাবাড়ির সামনে এবং পিরোজপুর সদর পুলিশ স্টেশনের এলজিইডি ভবনের পেছনের হিন্দুপাড়া ঘিরেহত্যা করেন দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডল, জগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, পুলিন বিহারী ও মুকুন্দ বালাকে।
অপরাধ-৫: তৎকালীন পিরোজপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাইফ মিজানুর রহমান সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। সাঈদী ও তার সহযোগী শান্তি কমিটির সদস্য মন্নাফ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাসদস্যকে নিয়ে ৫ মে পিরোজপুর হাসপাতাল থেকে তাকে ধরে বলেশ্বর নদের তীরে নিয়ে যান। একই দিনে পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ (লেখক হুমায়ূন আহমেদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের বাবা) এবং ভারপ্রাপ্ত এসডিও আবদুর রাজ্জাককেও কর্মস্থল থেকে ধরা হয়। সাঈদীর উপস্থিতিতে এ তিন সরকারি কর্মকর্তাকে গুলি করে লাশ বলেশ্বর নদে ফেলে দেওয়া হয়।
অপরাধ-৬: ৭ মে সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটির একটি দল পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে পারেরহাট বাজারের আওয়ামী লীগ, হিন্দু সম্প্রদায় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের বাড়িঘর ও দোকান চিনিয়ে দেয়। এসব দোকান ও বাড়িতে লুটপাট করা হয়। এ সময় তারা মাখন লাল সাহার দোকান থেকে ২২ সের স্বর্ণ ও রুপা লুট করে।
অপরাধ-৭: ৮ মে বেলা দেড়টার দিকে সাঈদী পাকিস্তানি সেনাদের নেতৃত্ব দিয়ে বাদুরিয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম খানের ছেলে শহীদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে নুরুল ইসলাম খানকে আওয়ামী লীগার ও শহীদুল ইসলামকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের হাতে সোপর্দ করেন। পরে তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
অপরাধ-৮: ৮ মে বেলা তিনটার দিকে সাঈদী ও তার দলের সদস্যরা চিথোলিয়া গ্রামের মানিক পসারির গ্রাম লুট করেন। এখানে পাঁচটি ঘরে কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মানিক পসারির ভাই মফিজুদ্দিন ও ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে সেনা ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার সময় সাঈদীর প্ররোচনায় পাকিস্তানি সেনারা ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা করে। মফিজকে সেনাক্যাম্পে নির্যাতন করা হয়।
অপরাধ-৯: ২ জুন সকাল নয়টার দিকে সাঈদী ও তার সশস্ত্র সহযোগীরা ইন্দুরকানি পুলিশ স্টেশনের নলবুনিয়া গ্রামের আবদুল হালিম বাবুলের বাড়িতে লুটপাট করে মূল্যবান জিনিসপত্র লুট এবং আগুন ধরিয়ে দেন।
অপরাধ-১০: ২ জুন সকাল ১০টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে সশস্ত্র দল উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার ২৫টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। সাঈদীর ইন্ধনে বিসা বালী নামের একজনকে নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়।
অপরাধ-১১: ২ জুন সাঈদী টেংরাখালী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে যান। সেখানে তার বড় ভাই আবদুল মজিদ হাওলাদারকে ধরে নির্যাতন করা হয়। এরপর সাঈদী নগদ টাকা লুট ও মূল্যবান জিনিস নিয়ে যান। পরে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
অপরাধ-১২: সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের একটি সশস্ত্র দল পারেরহাট বাজারের ১৪ জন হিন্দুকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে নিয়ে যায়। পরে তাদের গুলি করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
অপরাধ-১৩: মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই-তিন মাস পর সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা নলবুনিয়া গ্রামের আজহার আলীর বাড়িতে যায়। সেখানে আজহার আলী ও তার ছেলে সাহেব আলীকে ধরে নির্যাতন করা হয়। সাহেব আলীকে পিরোজপুরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
অপরাধ-১৪: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ৫০-৬০ জনের একটি রাজাকার বাহিনী হোগলাবুনিয়ার হিন্দুপাড়ায় যায়। রাজাকারদের আগমন দেখে গ্রামের অধিকাংশ হিন্দু নারী পালিয়ে যান। কিন্তু মধুসূদন ঘরামীর স্ত্রী শেফালী ঘরামী ঘর থেকে বের হতে পারেননি। তখন সাঈদীর নেতৃত্বে রাজাকাররা তাকে ধর্ষণ করেন। এর ফলে স্বাধীনতার পর তিনি একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেন। এ নিয়ে গ্রামে বিভিন্ন কথা ওঠায় শেফালী ঘরামী দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। পরে এই হিন্দুপাড়ার ঘরে আগুন দেওয়া হয়।
অপরাধ-১৫: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের রাজাকার দল হোগলাবুনিয়া গ্রামের ১০ জন হিন্দু নাগরিককে ধরে। পাকিস্তানি সেনারা তাদের সবাইকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
অপরাধ-১৬: সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জনের রাজাকার দল পারেরহাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ি থেকে তার তিন বোন মহামায়া, অন্ন রানী ও কমলা রানীকে ধরে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তিন দিন ধরে ধর্ষণ করে পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
অপরাধ-১৭: সাঈদী ও তার নেতৃত্বের রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পারেরহাটের বিপদ সাহার সাহার মেয়ে ভানু সাহাকে তার বাড়িতে আটকে নিয়মিত ধর্ষণ করেন। এক সময় ভানু সাহা দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। বর্তমানে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।
অপরাধ-১৮: ভাগীরথী পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে কাজ করতেন। সাঈদী এক দিন খবর দেন, ভাগীরথী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত নানা খবরা-খবর দেন। পাকিস্তানি সেনারা তাকে হত্যা করে লাশ বলেশ্বর নদে ফেলে দেয়।
অপরাধ-১৯: সাঈদী প্রভাব খাটিয়ে পারেরহাটসহ অন্য গ্রামের ১০০-১৫০ জন হিন্দুকে ইসলাম ধর্মে রূপান্তর করে। তাদের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে বাধ্য করা হতো।
অপরাধ-২০: নভেম্বরের শেষ দিকে সাঈদী খবর পান, সাধারণ মানুষ ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। তার নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি সশস্ত্র দল পরিকল্পিতভাবে ইন্দুরকানি গ্রামের তালুকদার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। ৮৫ জন ব্যক্তিকে আটক করে তাদের কাছ থেকে মালামাল কেড়ে নেওয়া হয়। ১০-১২ জন বাদ দিয়ে বাকিদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
২০টি মন্তব্য
আগুন রঙের শিমুল
ফাসি ফাসি ফাসি চাই
প্রজন্ম ৭১
আমরা চাইলেই তো আর ফাসী হবেনা।
ছাইরাছ হেলাল
অপেক্ষায় আমরাও।
প্রজন্ম ৭১
রায়ে হতাশ আমরা ।
বনলতা সেন
চাওয়া যেন পাওয়া হয়।
প্রজন্ম ৭১
চরম হতাশ বনলতাদি।
শুন্য শুন্যালয়
রায় হয়ে গেছে ভাইয়া। চাওয়া অবশ্যই পূরণ হয়েছে কারো কারো 🙁
প্রজন্ম ৭১
হতাশ, এমন হতাশ শিগ্র হইনি আপু।
নুসরাত মৌরিন
মাথা-মুথা খারাপ লাগতেছে!! 🙁
এদেশে আসলে বেঈমান আর রাজাকাররাই টিকে যাবে।শত শত খুন আর ধর্ষনের পুরষ্কার হিসেবে বিচার ব্যবস্থা তাদের দেবে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি।
ছিঃ শব্দটা ছাড়া আর কোন কথাই মাথায় আসতেছে না…।
প্রজন্ম ৭১
ছিঃ শব্দটা ছাড়া আর কোন কথাই মাথায় আসতেছে না…।
জিসান শা ইকরাম
এদেশে আসলে বেঈমান আর রাজাকাররাই টিকে যাবে।শত শত খুন আর ধর্ষনের পুরষ্কার হিসেবে বিচার ব্যবস্থা তাদের দেবে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি।
ছিঃ শব্দটা ছাড়া আর কোন কথাই মাথায় আসতেছে না…।
তীব্র ঘৃনা প্রকশ করছি রাজাকারদের প্রতি।
প্রদেয় রায়ে খুশী না ।
প্রজন্ম ৭১
প্রদেয় রায়ে খুশী না ।
মেঘাচ্ছন্ন মেঘকুমারী
সাজার নামে আমাদের আবেগের সাথে প্রতারনা করা হলো।
প্রজন্ম ৭১
একমত আপু আপনার সাথে ।
আম্মানসুরা
বিচার আর প্রহসন এখন সমার্থক শব্দ
প্রজন্ম ৭১
এর চেয়ে বড় প্রহসন আর হয়নি আমাদের বিচার ব্যাবস্থায়।
ব্লগার সজীব
তাকে যে মুক্তি দেয়নি এতে শুকরিয়া আদায় করেন।
প্রজন্ম ৭১
এটা ভালো বলেছেন সজীব ভাই।
স্বপ্ন
আমাদের চেতনা থেকে ৭১কে মুছে ফেলতে পারবেনা কেউ।
প্রজন্ম ৭১
মুছে ফেলা উচিৎ না ।