লনে গাছের নিচে দু’দিন যাবত বিশালাকৃতির টিভি’টি পরে থাকতে দেখি। রোদ, বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে ক্লিয়ার প্লাস্টিক ব্যাগ দিয়ে যত্নে ঢেকে রাখা। একটি কাগজে বড় হরফে ইংরেজিতে লেখা__ “কেউ চাইলে এটি নিতে পারো… ফর ফ্রি… গুড কন্ডিশন”। বলা বাহুল্য, এদেশে কেউ বাসা বদল করলে কিংবা নতুন ভাবে সাজাতে চাইলে পুরনো আসবাব ফেলে দেয়। কিছু বাঙালি অন্য শহরে মুভ করলে পত্রিকায় “বিক্রয় হবে” নামে একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে।
সদ্য দেশ থেকে আসা এক পরিবার। নতুন আসবাব কিনার সামর্থ্য নেই। এমন একটি বিজ্ঞাপন দেখে দেখতে যেতে চাইলেন। আমি নিয়ে যাই। গিয়েই বিস্মিত হই। চেনা মানুষ ! মলিন মুখ, খানিক অপ্রস্তুত। দেয়ালে স্বামী-স্ত্রী’র সুন্দর সুন্দর মুহূর্তের হাস্যোজ্বল ছবি। সুন্দর সাজানো গোছানো পরিপাটি বাড়িটির সব আসবাব বিক্রি করে বাড়িটি ছেড়ে দিবেন ভদ্রলোক। ব্যাচেলরদের সাথে উঠবেন কোথাও।
অনেক আগে আমরা দীর্ঘদিন পাশাপাশি ছিলাম।
আমাদের পারিবারিক ভাবে যাওয়া আসা, ভাল সম্পর্ক ছিল। সেই সময় তাঁদের সংসারে প্রথম নতুন অতিথি আসা উপলক্ষে খুব কাছের কয়েকটি পরিবারের সাথে আমাদের ডিনারের নিমন্ত্রন করে। আমরা যাই। আন্তরিক আপ্যায়ন, খুশির খবর__ সব মিলে চমৎকার একটি রাত ছিল। একদিন ভীষণ রকম এক দুঃসংবাদে পরিবারটিতে আঁধার নেমে আসে। আলট্রাসনোগ্রাম, ব্লাড টেস্ট সহ যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষায় জানা গেল__ শিশুটি প্রতিবন্ধী হিসেবে জন্মগ্রহন করবে। ডাক্তার সেই দম্পতিকে বোঝালো, ক্লাস করালো, ভাববার সময় দিল শিশুটি রাখবে কি রাখবে না। পৃথিবীতে এলে শিশুটি কষ্ট পাবে, সেই সাথে বাবা-মা’ও। শেষে তীব্র মনখারাপের মাঝে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যা শিশুটির জন্যে ভাল হবে।
অবশেষে বিশেষ ইনজেকশনের মাধ্যমে পাঁচ মাস বয়সী ছেলে শিশুটির হৃদস্পন্দন থামিয়ে দেয়া হল মায়ের গর্ভেই। সেই সময় রক্ত সম্পর্কহীন আমার অনেকগুলো নিদ্রাহীন রাত কেটেছিলো। সেই বাবা-মা’র অনুভূতি কোন শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কেননা, মনিটরে গর্ভস্থ শিশুটিকে তাঁরা দেখেছে একাধিকবার। শারীরিক কি কি ত্রুটি নিয়ে শিশুটি বেড়ে উঠছে, সেটি বারংবার দেখানো হয়েছে, যাতে করে তাঁরা একটি সিদ্ধান্তে সহজে উপনীত হতে পারে। মনিটরে দেখে দেখে মায়া লেগে যাওয়া শিশুটির ব্যপারে যে কোন সিদ্ধান্তে আসা মোটেও সহজ ছিল না। এক সন্ধ্যায় ভদ্রলোক মসজিদে দোয়া পড়ালেন। বাসায় তবারক নিয়ে এলেন। বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত তিনি আমাদের সবার কাছে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে দোয়া চাইলেন। বললেন, “মনে হচ্ছে নিজ হাতে সন্তানকে মেরে ফেললাম”।
দুঃস্বপ্নের সময়ও একটা সময় শেষ হয়।
বছর দুই বাদে তাঁদের একটি সুস্থ ছেলে জন্মায়। স্বামী-স্ত্রী’র নামের অদ্যাক্ষর নিয়ে শিশুটির সুন্দর একটি নাম রাখেন। স্ত্রলারে শিশুটিকে নিয়ে প্রতি বিকেলে তাঁরা হাঁটতে বের হয়। জানায়, তাঁদের এদেশে থাকার বৈধ কাগজ হয়েছে। দেশে যাচ্ছে সহসাই। সেই সময় তাঁদেরকে বর্ণনাতীত উচ্ছ্বসিত এবং আনন্দিত দেখাচ্ছিল। হাসিখুশি সুখী পরিবারটিকে দেখে আমার যারপরনাই ভাললাগে। কেননা, তাঁদের দুঃখের কষ্টের সময়গুলো খুব কাছ থেকে দেখা আমার।
দীর্ঘদিন পর দেশে গিয়ে স্বামী-স্ত্রী বিবাদে জড়িয়ে পরে। স্বামী চায়, যে কয়দিন দেশে থাকবে পরিবার নিয়ে নিজের মায়ের সাথে থাকতে। স্ত্রী চায়, তাঁর মায়ের কাছে থাকতে। দু’জনই অনড়। অবশেষে সময় ফুরিয়ে গেলে স্বামী’টি স্ত্রী সন্তানকে ফেলে একাকি ফিরে আসে। স্ত্রীর পাসপোর্ট পুড়ে ফেলে। জেদাজেদি’র শেষ পরিনতি___ বিচ্ছেদ !
অনাকাঙ্ক্ষিত বিচ্ছেদে বদলে গেল সুন্দর তিনটি জীবনের গতিপথ। অতঃপর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সব আসবাব বিক্রয়।
যাক্, যে কারনে এতো কথা___
কত তুচ্ছ কারনে মূল্যবান সম্পর্কগুলো, স্বপ্নগুলো, সুখগুলো চোখের সামনে তছনছ হয়ে যায় ! অথচ তুচ্ছ একটি টিভি কত যত্নেই না কেউ রেখে গেল, কারো কাছে মূল্যবান হয়ে উঠবে, সেই আশায়।
ছোটখাটো দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে যান
সম্পর্কগুলোর যত্ন নিন
জীবন সুন্দর হয়ে উঠুক
২৪টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
জীবনকে এত কাছে থেকে দেখা সহজ কাজ নয়, যদিও বাস্তবতা অনেক কঠিন।
কিছুটা ছাড় আমাদের দিতেই হয়, দেয়া উচিৎ ও।
রিমি রুম্মান
যখন ভেতরে জেদ চেপে বসে তখন কেউই আমরা ছাড় দিতে চাই না। একগুঁয়েমি পেয়ে বসে আমাদের। এটাই বাস্তবতা। আমরা ভাবিনা কি ক্ষতি করছি নিজেদের।
সিকদার
দুঃখজনক !!
রিমি রুম্মান
এটি খুব কাছ থেকে দেখা দুঃখজনক ঘটনা…
জীবন থেকে যত দেখছি, ততো শিখছি। ভাল থাকবেন।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
জীবন বড় অদ্ভুদ জীবনকে ছেড়ে দিতে হয়….নিয়তির কাছে। -{@
রিমি রুম্মান
শুভকামনা জানবেন। ভাল থাকবেন।
জিসান শা ইকরাম
প্রতিটি লেখায় আপনি একটি বার্তা নিয়ে আসেন
ভাল লাগে এমন লেখা।
আপনি প্রচুর ভাবেন,শিক্ষা নেন জীবন থেকে।
শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
আমাদের আশেপাশে প্রতিনিয়ত এমন কিছু ঘটনা ঘটছে। যেখান থেকে আমি শিখছি। লিখছি এ কারনে যে, কেউ যদি উপকৃত হয়। ভাল থাকবেন।
লীলাবতী
আপু আপনার কাছে লেখার অ আ ক খ শিখবো।শেখাবেন না?
রিমি রুম্মান
বড় লজ্জায় পরে গেলাম। আবার একটু পণ্ডিত পণ্ডিত ভাব এলো মনে 😀
মেহেরী তাজ
এতো সুন্দর করে লেখেন কি ভাবে আপু??
দামি কথা বলেছেন। চেষ্টা করবো রাগ আর জেদ কে কন্ট্রোল করতে
রিমি রুম্মান
জেদের বশবর্তী হয়ে আমরা ক্ষতিকর অনেক কিছু করে ফেলি, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাল ফল বয়ে আনে না। এটিই বাস্তবতা।
খেয়ালী মেয়ে
একেবারে তুচ্ছ কারণেই সম্পর্কটা ভেঙে দিলো, যা একদম ঠিক হয়নি 🙁
জীবনকে সুন্দর করে তোলার জন্য শেষে ম্যাসেজটুকু গুরুত্বপূর্ণ….
একটা সুন্দর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য এমন ছোটখাটো দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে যাওয়া উচিত…..
রিমি রুম্মান
কারণটি তুচ্ছ আবার অনেক বড়। যদি আমরা কেউ কাউকে বুঝার চেষ্টা না করি তাহলে কারণটি অনেক বড়। আবার বুঝার চেষ্টা করলে একেবারেই তুচ্ছ ঘটনা এটি। ভাল থাকবেন। শুভকামনা রইল।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হায় হায়, এ কেমন জীবনকাহিনী শুনালেন! এই সামান্য একটি কারনে ঘর ভেঙ্গে গেলো? দুজনের জেদই মুল হয়ে উঠলো? কেনো রে বাবা, দুজনেই তো অনেককাল পর দেশে ফিরেছো। দুজনেরই আপনজনের কাছে থাকার ইচ্ছে কাজ করবে, এইতো স্বাভাবিক। তাহলে কম্প্রোমাইজ নয় কেনো?
কেনো যে মানুষ ন্যায়সম্মত অধিকারে হস্তক্ষেপ করে? স্বামীর বুঝা উচিত ছিলো, তার যেমন মায়ের কাছে থাকতে ইচ্ছে করে, স্ত্রীরও তেমনি তার মায়ের কাছে থাকতে ইচ্ছে করবে। আবার স্ত্রীরও বুঝা উচিত ছিলো, এতোদিন পরে যেহেতু দেশে এসেছে; যে পরিবারের বউ সে পরিবারও তাকে এবং তার সন্তানকে কাছে চায়। কাজেই দুজনে আলোচনা করে ভাগাভাগি করে থাকলেই হতো।
দাম্পত্যজীবনকে সুন্দর রাখতে গেলে কম্প্রোমাইজ মাস্ট তবে একতরফা কিছুই সম্ভব নয়।
সবশেষে বলবো, আপনার জীবন থেকে নেয়া এই গল্পগুলোর মাঝে কমবেশি ম্যাসেজ থাকে। ভালো লাগে পড়তে।
রিমি রুম্মান
রুবা, আপনাকে একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি। প্রথমবার আমি দেশে যাই পাঁচ বছর বাদে। শ্বশুরবাড়ির দুটি বিয়ের প্রোগ্রাম ছিল। দুটো বিয়েতে অনুষ্ঠান ৫+৫=১০ টি। কেমন করে যেন ২/৩ সপ্তাহ চলে গেল। আমার আনন্দ হয় না। মন পরে রয় কখন বাবার বাড়ি যাবো। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে খুশিতে আত্নহারা। এবার বাবার বাড়ী যাবো। যৌথ পরিবারের বউ, বিধায় মুরুব্বীদের কথা না শুনেও উপায় নেই। তাঁরা নবদম্পতিদের সাথে আমাদের প্লেন টিকেট, হোটেল বুকিং দিল হানিমুনে যাবার ! আমি খুশি না হয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। বাধ্য হয়ে সবাইকে খুশি করতে চললাম নব দম্পত্তিদের সাথে। একমাস কেটে গেল। আমার আসবার সময় ঘনিয়ে আসে। এরই মাঝে শ্বশুরবাড়ির মানুষজন আমার বার্থডেয় পার্টির আয়োজন করে। আমি না করতে পারিনি। ভেতরের ক্ষরণ লুকিয়ে রেখে সেটিও শেষ করি। এরপর দেখি আমার বাবার পরিবারের সাথে থাকবার সময় আছে মাত্র ১৫ দিন ! একদিকে মধুর ভালবাসা অন্য দিকে পাথর চাপা কান্না। এটিই বাস্তবতা।
নীলাঞ্জনা নীলা
আজীবন মেয়েরাই কমপ্রোমাইজ করে যায়। দেশে গেলে শ্বশুরবাড়ীতে থাকতে, বাবার বাড়ী যাওয়া যাবে কিন্তু তা ৩ দিনের জন্য। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখে এসেছি। খুব কম শ্বশুরবাড়ী আছে যেখানে বৌদেরকে এমন শাস্তি দেয়া থেকে বিরত থাকে। এটাই তো স্বাভাবিক এতোগুলো বছর পর দেশে গেলো মেয়ের তো ইচ্ছেই করবে বাবা-মায়ের সাথে কিছু সময় কাটাতে। স্বামী এবং স্ত্রী দুজনকেই কম্প্রোমাইজ করতে হবে।
ভাগ্য ভালো এমন পরিস্থিতিতে আমায় পড়তে হয়নি। কোনো মেয়েদের যেনো এমন ভয়ানক পরীক্ষার মুখোমুখি না হতে হয়। আপনার প্রতিটি লেখায় জীবনের গল্প যা মনকে ভেঁজায় আবেগের জলে। -{@
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। প্রবাস থেকে যারা দেশে যায়, তাঁদের প্রায় সবারই এমন সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মানিয়ে চলতে না জানলেই সমস্যা …
ব্লগার সজীব
অনাহুত এই ঘটনায় কষ্ট পেলাম আপু।
রিমি রুম্মান
খুব কাছ থেকে দেখা ঘটনা। আমার কষ্ট লেগেছে আরও বেশি। ভাল থাকবেন।
শুন্য শুন্যালয়
খুব তুচ্ছ কারনে এমন সম্পর্ক নস্ট হয়না আপু। হয়তো অনেক কিছুই জানিনা তাদের ভেতরের। নারীদের কম্প্রোমাইজটাই যেন সবকিছুর ভিত্তি। খুবই মন খারাপ হলো। সম্পর্কের এই জটিলতা যেন শেষ হবার নয়।
রিমি রুম্মান
খুব কাছ থেকে দেখা। দুজনের বক্তব্য শুনা এবং তৃতীয় পক্ষের সমাধানের নামে সমস্যা বাড়িয়ে তোলা সবই কাছ থেকে দেখেছি। উপলব্দি করেছি__ দু’জন মানুষ এক ছাদের নিচে বসবাস কথা খুবই কঠিন। কোন একজনকে মানিয়ে নিতেই হয় টিকে থাকবার জন্যে।
স্বপ্ন
আপনার সব লেখায় আপনার দেয়া একটি মেসেজ থাকে আপনার।ভালো লাগে খুব।
রিমি রুম্মান
মেসেজ থেকে যদি কারো উপকার হয়, সেই ভেবে লেখা আমার। ভাল থাকুন সব সময়।