অবক্ষয়!

মারজানা ফেরদৌস রুবা ৭ আগস্ট ২০১৫, শুক্রবার, ১২:০০:৫৯পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি, সমসাময়িক ১৭ মন্তব্য

একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না ‘নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না।’

সমসাময়িক পরপর কয়েকটি বোধহীন অস্বাভাবিক ঘটনা-
* শিশু ধর্ষণ (রাজধানীর ভাটারায় ১২ বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর বাসায় দিয়ে গেছে। গতকালের খবর ।
* ঢাকা মেডিকেলে স্যুটকেসে শিশুর লাশ।
* দলবেঁধে গণধর্ষণ ( উত্তরায় এক সহকর্মীকে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দলবেঁধে গণধর্ষণ, যা ১লা বৈশাখের রমনা ঘটনার পর থেকে একপ্রকার বেপরোয়া গতি পেয়েছে। )

* বরগুনার রবিউল হত্যাকাণ্ড ( পুকুর থেকে সামান্য মাছ চুরির অপরাধে মাছচাষী বাচ্চাটির একটা চোখ তুলে ফেলে তাকে হত্যা করে)
* খুলনার রাকিব হত্যাকাণ্ড (চরম শাস্তি দিতে গিয়ে পাশবিক নির্যাতন। ফলাফল অপমৃত্যু)।
* সিলেটের রাজন হত্যাকাণ্ড (খেলিয়ে খেলিয়ে হাস্যরসের মাধ্যমে পাশবিক নির্যাতন। ফলাফল অপমৃত্য)। *

* একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মহত্যা (রাজাকারের এক সময়ের সহচর দ্বারা অপমানিত হয়ে ঘেন্নায় আত্মহত্যা)।

বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের মাঝে পড়ে অস্বাভাবিক দুর্ঘটনা –
*সরকারদলীয় দু গ্রুপের গুলাগুলি চলাকালে মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় শিশু আক্রান্ত।

এরকম বিভৎস ঘটনার খবর এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সমাজ তথা রাষ্ট্রের পরিবর্তন আনতে গেলে ঘর হতেই প্রথম শুরু করতে হয়। জন্ম নেয়ার পর মানবশিশুর পৃথিবীর সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে তার মায়ের কোল থেকে। এরপর সে পরিবারের অনুশাসনে বেড়ে উঠে এবং শিক্ষালয়ে শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি আস্তে আস্তে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের মাধ্যমে সমাজের বৃহত্তর গণ্ডিতে পা রাখে। পরিবার এবং বিদ্যালয় হচ্ছে মানবশিশুর শিক্ষা অর্জনের প্রাথমিক সুতিকাগার। শিশুর সুপ্তমনে এই সময়টাতেই মনোজগতের বিকাশ ঘটে।
অন্যায় অন্যায়ই। অন্যায় করলে শাস্তি পেতে হবে। ঘরেই অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ঘরে অন্যায় করে পার পেযে যাওয়ায় বাইরেও এর প্রভাব পড়ছে। একবার ভাবুন তো, যে কুলাঙ্গার সন্তানটি ধর্ষণের মতো পাশবিক ও অমানবিক অপরাধ করছে সে কি তার পরিবার থেকে বিতাড়িত হচ্ছে? হচ্ছে না।
মানুষ পরিবার-পরিজন ছাড়া থাকতে পারে না। কাজেই পরিবারই হচ্ছে প্রধান বিচারালয়। অন্যায়কারী পরিবারে আশ্রয় না পেলে সমাজেও সে পরিত্যাক্ত।
শিশু রাজনের হত্যাকারী ময়না মিয়ার মায়ের মতো মা এখন এদেশে বিরল। যে মা তাঁর অপরাধী সন্তানকে নিজেই পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন।
অন্যদিকে, বর্তমানে আমরা এমনই এক আত্মকেন্দ্রিক জাতিতে পরিণত হযেছি যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন সমস্যা আমাদের নিজেদের উপর আঘাত না আনছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। ফলশ্রুতিতে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। ছোট্টবেলায় পড়েছি, কয়েকজন ব্যক্তি মিলে পরিবার, কয়েকটি পরিবার মিলে মহল্লা (সমাজ), কয়েকটি মহল্লা মিলে নগর, কয়েকটি নগর মিলে দেশ তথা রাষ্ট্র। উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুজে আমরা কেবল নিজেদেরই ঠকাচ্ছি।
কারন, সমাজে পচন ধরলে তা ঘর পর্যন্ত এসে ঠেকে।

যে দেশে নেতার নির্দেশে কর্মীবাহিনী হাসতে হাসতে উৎসব করে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারে। সে দেশের মানুষের মননে মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হবে নাকি পশুত্ববোধ জেগে উঠবে?
শিশু মুনিরের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পৈশাচিক উল্লাস। মুনির শরীরে আগুন নিয়ে চিৎকার করে দৌড়াচ্ছে আর অনুগত কর্মীবাহিনী হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে আর ভাবছে মনে হয় এবার দলে একটা যুৎসই পদবী জুটাতে পারবো। ধিক!
অথচ বিচারহীনতার সংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ এই দেশে হুকুমের আসামী হিসাবে সেই নেতার কাছে এখনো কোন জবাবই চাওয়া হয়নি।
যে দেশের গণমানুষের নেতা এমন বিকারহীন মানসিকতা নিয়ে নেতৃত্ব দেন, সে দেশে বোধ-বিবেচনাহীন প্রজন্ম গড়ে উঠবে, এইতো স্বাভাবিক।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো।” (হুবহু হয়তো উক্তিটি তুলে ধরা হয়নি)। কথাটি বোধ হয় একজন নেতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারন নেতাকে তাঁর অনুগত কর্মীবাহিনী ছায়ার মতো অনুসরন করে। কাজেই ভ্রান্ত নেতৃত্ব যেমন একটি জাতিকে অন্ধকার গহ্বরে পতিত করে, তেমনি আবার সঠিক নেতৃত্বের কারনে একটি জাতি আলোর পথেও হাটতে পারে। যাহোক, এখনো সময ফুরিযে যায়নি। বর্তমান সামাজিক কাঠামো ভঙ্গুর হলেও আলোর দিশা খুঁজে পেলে খেই হারানো প্রজন্মও এক সময় ঘুরে দাঁড়াবে আর নষ্ট সমাজের কালো ছায়াও ধীরে ধীরে দূর হবে। মানুষের মাঝে নৈতিকতাবোধ, মনুষ্যত্ববোধ ফিরে আসবে। কাজেই জাগো সমাজ।

’৭৫ পরবর্তী সময়ে রাজাকার পুর্নবাসনের মাধ্যমে সমাজে কালো ছায়ার প্রভাব পড়েছিলো। এবং ২০০১ সালে রাজাকার উত্থানের স্বর্নযুগে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা রাজাকার সহচরেরা সুযোগ পেলেই তাদের কালো থাবা বসিয়ে দেয়। এখন সময় এসেছে সেদিকেও নজর দেয়ার।
আচ্ছা! মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সেই সচিবের খবর কি?
ভুললে চলবে না আমাদের সুর্য সন্তানদের একজন কিন্তু তারই কারনে অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। তাও আবার এই স্বাধীন দেশেই এবং স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির দেশ পরিচালনাকালেই। দলে এবং সরকারে সুবিধামতো রঙ পরিবর্তনকারী গিরগিটির মতো মিশে যাওয়া আর কোন রাজাকার সহচর যেনো তাকে রক্ষার কোনরকম সুযোগ না পায়।

সুরাইয়া আজ হাসছে। তাৎক্ষণিক সাপোর্ট দেয়ায় সুস্থ হয়ে মায়ের কোলে ফিরে এসেছে। এখনো বুঝার উপায় নেই যে, সে পরিপূর্ণ সুস্থ জীবন যাপন করতে পারবে কি না। বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডে যেমন দলীয় পরিচয়ে কেউ রেহাই পায়নি, তেমনি দলবাজিতে পড়ে যে শিশুটি এতোদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছে, মায়ের গর্ভে শিশুটির জীবন বিপন্নকারীরা যেনো বুঝতে পারে সন্ত্রাসী কাজে কোন দলীয় পরিচয় নেই। সন্ত্রাসীদের কোন দল নেই।

সমাজের মানবিক স্তরগুলো দিন দিন ভেঙ্গে যাচ্ছে। মানুষদের বিবেক ও মূল্যবোধ কোন স্তরে নামলে এমনটি ঘটা সম্ভব?
অপরাধ করে যখন অপরাধীরা পার পায়, তখন আরও দশ অপরাধীর জন্ম হয়, তাদের সাহস বাড়ে। মনে হয়, কই, কিছুই তো হয় না।

তাই বলছি, জাগো সমাজ! জাগো মানুষ!
আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, সবাই আওয়াজ উঠান। এসব অমানবিক হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হোক, যাতে করে খুব দ্রুত অপরাধীর শাস্তি কার্যকর করা সম্ভব হয়। বিচারেরর দীর্ঘসুত্রিতার কারনে অপরাধীরা যেনো পার পেয়ে না যায়।

**এতোকিছুর পরও একজন দুজন মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন মানুষ এখনও এই ঘুণেধরা সমাজে আছে, যারা নিজের জীবন বিপন্ন করেও পরোপকার করতে ঝাপিয়ে পরে। তেমনই একজন মানবিক গুনসম্পন্ন মানুষ ময়মনসিংহের নান্দাইলের কড়াইল বস্তির বাসিন্দা মোঃ সুমন। একটি ৫/৬ বছরের বাচ্চা রেললাইনের উপর খেলা করছিলো, তাকে বাচাঁতেই সে এগিয়ে যায়। বাচ্চাটিকে বাচাঁতে পারলেও সুমন নিজে চলন্ত ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা যায়। সুমনের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি আর আশা করছি সুমনের পরিবার সরকারের নেক নজর পাবে।

মানুষ মানুষেরই জন্য। জয় হোক মানবিকতার।
অস্থির সমাজে শান্তি ফিরে আসুক।

৪৮৫জন ৪৮৫জন
0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ