তেরঃ
বেজ ক্যাম্পে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেলো। তবে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, নীলসাধুর সাথে দেখা করার পর থেকেই অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেছে মনটা। আগের মত অস্থিরতা নেই। কারণটা বোধহয় স্মৃতিশ্বরকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এমন অস্ত্র আছে আমার কাছে।
বেজ ক্যাম্পে ফিরে চিন্তা করে নিলাম একটু। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কোন ফল নেই এই চিন্তায়। আরিশার কিছু হলে পাহাড়ে আবার অশান্তি দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে ওয়ালিদকে উদ্ধার করতে না পারলে ওর কি হবে সেটা বলা মুশকিল। হিসেব করলে হয়তো দেখা যায়, ওয়ালিদকে নিয়ে স্মৃতিকে শান্তিতে থাকতে দিলেই সমস্যার সমাধান সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু অশুভ ক্ষমতার অধিকারিণী কি কেবল এতেই সন্তুষ্ট থাকবে! পরে তার এই উদ্দেশ্য সাধনের পর কি সাধারণ মানুষদের ক্ষতি করবে না!
প্রশ্নগুলো নীলসাধুকে করলে ভালো হতো মনে হয়। তখন এত কিছু মাথায় আসেনি। অনেক সহজ ব্যাপার মনে হচ্ছিল।
আচ্ছা একটা কথা ……
নীলসাধু তো অনেক কিছুই জানে। কিভাবে জেনেছে সে এই প্রশ্ন কিন্তু নিজেই আমাকে করেছে। সে কি জানত না যে আমি এই প্রশ্নের জবাব জানি ! তার ভাব দেখে মনে হয়েছিল জানত না। তাহলে প্রশ্ন করে সে কি আমাকে তার জানার পন্থা কোনটি সেটি বলে দিয়ে কোন দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল!
সাধারণভাবে সাধু-সন্ন্যাসীরা প্রখর ইন্দ্রিয়ের অধিকারী হয়। আর তারা কোন কিছুর জবাব খুঁজে তাদের পবিত্র দিকগুলোতে। পবিত্র দিক হচ্ছে ৭টা। উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম, উপর-নীচ। আর সপ্তম দিকটি হচ্ছে মানুষের হৃদয়। মানুষের ইন্দ্রিয় পাঁচটা। নাক, কান, চোখ, জিহ্বা আর ত্বক। ধরে নেওয়া হয় ষষ্ঠ আরেকটা ইন্দ্রিয় আছে, যেটা অবশ্য সাধনার ফলে মিলে। আর সেই ইন্দ্রিয়টা হৃদয়ে অবস্থিত।
যারা সাধনা করে তাদের কাছে এই সপ্তম দিকটি সর্বাপেক্ষা পবিত্র এবং তাৎপর্যময়। কিন্তু আমি তো কোন সাধু-সন্ন্যাসী নই। তাহলে আমাকে ওই সপ্তম দিকে জবাব খুঁজতে বলার মানে কি! নাকি আমাকে নয়, আমার মাধ্যমে বার্তাটি আরিশার কাছে দিতে চেয়েছেন নীল-সাধু। যে কোন কিছুই হতে পারে, বলা মুশকিল হচ্ছে!
সকল দ্বিধাদন্দ্ব ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। মেডিকেল ক্যাম্পের তাঁবুতে ঢুকতেই দেখি আরিশা বসে আছে বিছানাটায়। সুস্থ হয়ে গেছে আগের চেয়ে অনেক। চেহারায় সতেজ ভাবটা ফিরে এসেছে।
আমাকে দেখেই বলে উঠলো,
“ আমার কথার প্রমাণ পেয়েছেন নিশ্চয়ই? ”
– কি করে জানলেন? আমি তো সে কথা কাউকে বলিনি।
– আমার মন বলছে। আর আমার মন ভুল বলে না।
এক মূহুর্ত চুপ থাকলাম। এরপরে বললাম,
“ নীল সাধু বোধহয় তাহলে আপনার জন্য মেসেজ দিয়েছে! ”
– নীল সাধু! কি বলেছেন?
– বলেছেন স্মৃতিশ্বরের মোকাবেলা আপনাকে করতে।
– আর ?
– আর বলেছেন উনি যেভাবে সবকিছু জেনে যান সেই পন্থা অনুসরণ করতে।
– এর পরিণাম কি সেটা বলেছেন?
– সেটা উনি জানেন না, তবে এটা বলেছেন যে অশুভ শক্তির পক্ষে যাবে না কখনোই।
দীর্ঘ এক মূহুর্ত চুপ থাকলো আরিশা। এরপরে আবার মুখ খুললো,
“ স্মৃতির সাথে আপনার দেখা হয়েছিল? ”
– হ্যাঁ দেবীপুরে।
– ওয়ালিদ ?
– ওর সাথেই ছিল।
– ওর কি মনে আছে আমার কথা?
– হ্যাঁ। আমি বলার পর হটাৎ মনে পড়েছে। এরপরে ওরা গায়েব হয়ে গেছে। এখন মনে আছে কিনা জানি না।
আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠলো তার চোখে।
“ আপনি কি জানেন ওদের কোথায় পাওয়া যাবে? ”
– নাহ। স্মৃতি বলেছিল আমি যদি বেঁচে ফিরি তাহলে স্মৃতির দূর্গে যেন খোঁজ করি। আর সাধুকে জিজ্ঞেস করার পর বললো স্মৃতি কোথায় সেটা নিয়ে যেন চিন্তা না করি। ওটা নাকি আপনি ভালো জানেন!
এক মূহুর্ত ভেবে নিলো সে।
“ সাধু কি তাই বলেছে ? ”
– জ্বি।
– তাহলে তাই ঠিক।
– কোথায় আছে তারা?
– আপাতত জানি না। তবে সাধু যেহেতু বলেছেন, জেনে যাব শীঘ্রই!
আর কোন কথা নেই। উঠে চলে আসলাম সেখান থেকে। এখন কেবল অপেক্ষা …
চৌদ্দঃ
পরদিন সকালে নিজের তাঁবুর সামনে বসে ছিলাম। এমন সময়ে এক সৈনিক এসে বললো,
“ স্যার! আপনাকে আরিশা ম্যাডাম ডাকছে। ”
এক মূহুর্ত দেরি না করে গেলাম মেডিকেল ক্যাম্পের তাঁবুতে। আরিশার মধ্যে অসুস্থতার ভাব একদমই নেই। চাঞ্চল্য প্রকাশ পাচ্ছে চোখে-মুখে।
আমাকে দেখে এবার আর আগের দুবারের মত কথা বলে উঠলো না। চুপ করে রইলো।
কিছুক্ষণ সময় যাওয়ার পর আমি নিজেই মুখ খুললাম এবার,
“ কি ব্যাপার! ডেকে পাঠিয়েছেন যে? ”
– আমি জেনে গেছি তারা কোথায় গেছে।
– কোথায়?
– আপনাকে বলা যাবে না।
– কেন?
– বললে আপনি আমার সাথে যাবেন তাই।
– আপনাকে আমি একা যেতে দিব কেন? মাথা খারাপ নাকি!
– আমাকে একাই যেতে হবে, কমান্ডার!
– কেন?
– কারণ এ আমার ভালোবাসার লড়াই।
– আমি গেলে কি হবে?
– আপনি ভালোবাসা থেকে যাবেন না। আপনি যাবেন কর্তব্যবোধ থেকে। আর স্মৃতি আমার লড়াই ভালোবাসার লড়াই। এ লড়াইয়ের সামনে অন্য সব কিছুর শক্তি এখন তুচ্ছ।
– আমি আপনাকে একা যেতে দিব না।
একটু রাগ করে চলে আসলাম, যেটা মস্তবড় এক ভুল ছিল। সেটা অবশ্য টের পেয়েছি ঘণ্টাখানেক পর। কল্পনাও করিনি যেটা হতে পারে সেটাই হল। ক্যাম্প থেকে উধাও হয়ে গেল আরিশা।
খবরটা জেনেই ছুটে আসলেন কর্ণেল ফারুক। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন সকালে কোন কথা হয়েছিল কিনা।
“ উনি বলছিলেন উনি নাকি জেনে গেছেন কোথায় আছে ওয়ালিদ। ” – নিজেকে আড়াল করেই জবাবটা দিলাম.
প্রচণ্ড বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন কর্ণেল ফারুক।
“ কি! কোথায় সে? ”
– সেটা বলেনি। কারণ বললে আমরা তাকে একা যেতে দিব না। আর যেখানে গেছে সেখানে নাকি তার একলাই যেতে হবে। ওয়ালিদকে নাকি কোন দেবী অপহরণ করেছে। তাদের দুজনের লড়াই হবে ভালোবাসার যুদ্ধ যেখানে আমাদের অংশটা নাকি খুবই তুচ্ছ।
কথাগুলো হজম করতে লাগলো কর্ণেল ফারুকের। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন,
“ মেয়েটার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে মনে হয়! ”
“ এখন কি হবে তাহলে? ” – কথা বলে উঠলেন বেজ ক্যাম্পের সহকারি কমান্ডার লেঃ কর্ণেল আনিসুজ্জামান। “ পুরো পাহাড়ে ভয়ংকর একটা অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। আরিশার যদি কিছু হয় আর সেটা যদি আমাদের কোন অবহেলায় হয় তাহলে আমাদের ভয়াবহ কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। ”
“ যেভাবেই হোক আরিশাকে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, অক্ষত অবস্থায়। কমান্ডার, দ্রুত আপনার টিম নিয়ে মুভ করুন। পুরো পাহাড় তন্ন তন্ন করে ফেলুন। বেশিক্ষণ আগে উনি যায়নি, সুতরাং বেশিদূর যেতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। ” – জরুরী গলায় নির্দেশ দিলেন কর্ণেল ফারুক।
“ ওকে কর্ণেল। ” – বলেই ছুটলাম। নিজের কমান্ডকে তৈরি হতে নির্দেশ দিয়েই বেরিয়ে পড়লাম নীল সাধুর সাথে কথা বলার জন্য।
নীল সাধুর কাছে যেতেই দেখি চেহারায় একটা অস্থিরতার ছাপ পড়েছে। আমাকে দেখে আগের বারের মত সম্ভাষণমূলক কোন কথা এবার বললেন না।
বরং বিড়বিড় করতে লাগলেন,
“ অনূসুয়া বিপদে পড়েছে, ইশ্বর! তুমি তাকে রক্ষা কর। ”
কথাটা শুনেই স্থির হয়ে গেলাম। তবে কি অশুভ শক্তির কাছে পরাজিত হতে যাচ্ছে অনূসুয়া!
পনেরঃ
“ কোথায় গেছে অনূসুয়া? বলুন আমাকে! ” – বলে উঠলাম আমি।
– আপনাকে বলেনি কোথায় গিয়েছে?
– নাহ।
– কেন?
– কারণ এটা নাকি তাদের ভালোবাসার যুদ্ধ। আমাদের কর্তব্য পালনে কোন শক্তি নেই। তাদের শক্তির কাছে আমরা তুচ্ছ।
– ভুল বলেছে। আপনারা ন্যায়ের পক্ষে যাবেন, সুতরাং আপনাদের পক্ষেও অনেক শক্তি কাজ করবে। কিন্তু দেবী স্মৃতিশ্বর আছেন পবিত্র মোহনায় যেখানে সকল শক্তি গিয়ে পুঞ্জীভূত হয়। অনূসুয়ার পক্ষে সম্ভব না সে জায়গায় গিয়ে স্মৃতিশ্বরকে পরাজিত করার।
– কেন? তার না অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা আছে?
– আছে। কিন্তু সে ভালোবাসার জন্য হিংসা প্রদর্শন করে ফেলেছে। তাই তার ক্ষমতাকে ছাপিয়ে গেছে স্মৃতির ক্ষমতা।
– কিন্তু ওয়ালিদ তো স্মৃতিকে ভালোবাসে না?
– ওয়ালিদের মগজে অনূসুয়া, অন্তরে খুব একটা না। তাই স্মৃতি চাইলেই তাকে ভুলিয়ে রাখতে পারে। সুতরাং ওয়ালিদের অবস্থান এখানে মুখ্য না।
– তাহলে আমি আরিশা বলার পরেই কেন ওয়ালিদের মনে পড়েছিল?
– কারণ আপনারা ন্যায়ের পক্ষে লড়ছেন, পবিত্র জন্মভূমিকে রক্ষার জন্য লড়ছেন, ইশ্বর আপনাদের সাহায্য করেছিলেন।
– তাহলে এখনও কি করবেন?
– অবশ্যই, মনে রাখবেন ইশ্বরের নামে সবকিছুর শুরু আর শেষ হয়। আর হ্যাঁ, স্মৃতিশ্বর এখন ওই জায়গা ছাড়া ক্ষমতাহীন। কারণ ক্ষমতা নিয়ে সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
– ওই জায়গায় তার শক্তির উৎস কি তাহলে ?
এক মূহুর্ত থেমে রইলেন নীল সাধু। এরপরে বলতে লাগলেন,
“ এখান থেকে প্রায় ৩০ কি.মি. উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত একটি জায়গা আছে। দুই পাহাড়ি নদী তীব্র বেগে সেখানে মিলিত হয়েছে। ধারণা করা হয় সকল শক্তির পুঞ্জীভূত হওয়ার জায়গা ওইটা। জায়গাটায় পাশাপাশি দুইজোড়া পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে দুটি নদী প্রবাহিত হচ্ছে, আর মাঝে একটা ছোট্ট উপত্যকার মত আছে। সেখানে নাকি একটা মন্দির আছে। সেই মন্দিরের নাম, ‘ স্মৃতির দূর্গ ’ যেখানে স্মৃতির দেবীর অর্চনা করা হয়। এইজন্যই সেখানে স্মৃতি বেশি শক্তিশালী কারণ তার অর্চনা করে অনুসারীরা শক্তি বাড়িয়ে দেয়। ”
– এত দ্রুত এত দূর্গম জায়গায় আরিশা গেল কিভাবে?
– ভালোবাসার তীব্র শক্তি দিয়ে।
আর কথা না বলে বেজ ক্যাম্পে ফেরৎ আসলাম। এসে শুনি চার্লি কমান্ডের দুইটি টিম এরই মধ্যে পাহাড়ে তল্লাশি চালাতে রওনা হয়ে গেছে। স্থানীয় এক চাকমা কে জিজ্ঞেস করলাম পবিত্র মোহনার কথা। সে অবশ্য কোনদিন সেখানে যায়নি তবে লোকেমুখে শুনেছে কোন পথে যেতে হয়। সেই বাতলে দিল আমাদের পথ।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগে গেল দূর্গম সেই জায়গাটায় যেতে। আমার সাথে আর কোন কমান্ডো আসতে পেরেছে। জায়গাটা এতই দূর্গম যে, প্রশিক্ষিত কমান্ডোরাও পাড়ি দিতে পারেনি। তীব্র খরস্রোতা একটি নদী পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে আমাদের।
যারা আসতে পারেনি তারা এখন সেই নদীর তীরে অপেক্ষমান। এভাবে একা একা চলে আসাটা হাস্যকর। কিন্তু আমার জেদ চেপে গেছে। এর শেষ দেখেই ছাড়ব আমি!
হটাৎ করেই সুদৃশ্য মন্দিরটা চোখে পড়লো। অদ্ভুত সুন্দর এক মন্দির। জানা নেই যে এখানে এরকম মন্দির আছে! সাধু না বললে কোনদিন হয়তো জানতেও পারতাম না।
সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে যেতেই দেখতে পেলাম এক চলমান নাটক …
সাদা শাড়ি গায়ে দেওয়া স্মৃতিশ্বরকে এখন সত্যিই দেবীর মত লাগছে। আরিশাকে দেখতে পেলাম তার সামনের মঞ্চে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। মঞ্চের পেছনে জনা বিশেক পুরুষ-মহিলা বসে আছে প্রার্থনার ভঙ্গিতে। আর ওয়ালিদ …
ওইতো সে। নদীর কিনারের রেলিংটায় বসে আছে চুপচাপ। অদ্ভুত ঘোরে রয়েছে সে!
একটু এগিয়ে যেতেই শুনতে পেলাম স্মৃতিশ্বরের কণ্ঠ …
“ এই চাকমা রাজকুমারীকে আমার প্রিয়তমের সাথে অবৈধ ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাচ্ছে … ”
আর কিছু শুনতে ইচ্ছে হলো না। হটাৎ করেই মাথায় যেন আগুন ধরে গেছে আমার। বন্দুকটা তাক করে সোজা ঢুকে পড়লাম। আমাকে দেখে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলো স্মৃতি। ভয়ংকর কণ্ঠে বলে উঠলো,
“ কমান্ডার! ”
– জ্বি, আমি।
– কোন লাভ নেই এখানে এসে। আপনিও মরবেন।
প্রচণ্ড হিসহিস করে উঠলো তার কণ্ঠ।
“ আমি মরলে মরব কিন্তু আরিশার কিছু হতে দিতে পারি না। ”
– আপনি ঠেকাবেন?
বিদ্রুপের স্বর তার কণ্ঠে।
মেজর ওয়ালিদের ঘোর কেটে উঠছে একটু একটু। আরিশা নামটা শুনতেই একটু চঞ্চল হচ্ছে, সেটা অবশ্য স্মৃতি খেয়াল করছে না। কৌশল করে তাই বলতে লাগলাম,
“ হ্যাঁ আমিই আরিশাকে ক্ষতির হাত থেকে ঠেকাব। ”
– তাহলে ঠেকিয়ে দেখান।
বলার সাথে সাথেই মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করলাম। বুঝতে পারছি এভাবে হবে না। শেষ চেষ্টা হিসেবে চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“ মেজর ওয়ালিদ! আপনার আরিশাকে বাঁচান আপনি। এই স্মৃতিশ্বরের ভ্রান্ত ছলনায় তাকে ভুলে যেয়েন না। ”
অদ্ভুত কাজ করলো কথাটা। মূহুর্তের মধ্যে ওয়ালিদ রূপান্তরিত হলো আর্মির এক মেজরে। প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় সে লাফিয়ে পড়লো স্মৃতিশ্বরের সামনে।
বিস্ময়ে হতবাক স্মৃতি কিছু করার আগেই উঠে দাঁড়ালো তার এক অনুসারী। ওয়ালিদকে প্রচণ্ড আঘাত করে বসলো সে। ফলে একেবারে তীব্র খরস্রোতা নদীতে গিয়ে পড়লো মেজর ওয়ালিদ।
প্রচণ্ড ক্রোধে চিৎকার করে উঠলাম স্মৃতি। আমি গুলি চালালাম এলোপাথাড়ি। হটাতই সব অনুসারী বাতাসে মিলিয়ে গেল। থমকে গেলাম আমি। মন্দিরটার মধ্যে এখন আমি, আরিশা আর স্মৃতি এই তিনজন।
“ আমার সাথে লাগতে এসে অনেক বড় ভুল করেছেন কমান্ডার। ” – কেমন ভয়ংকর শোনাচ্ছে তার কথাগুলো! “ আপনাকে আগেই শেষ করে দেওয়া উচিত ছিল। যাই হোক, এক ভুল বারবার করা যায় না। ”
মৃত্যু আসন্ন জেনেও অদ্ভুত শান্ত গলায় জবাব দিলাম,
“ জন্মমৃত্যু হয় ইশ্বরের নামে, আপনি স্মৃতির দেবী হতে পারেন কিন্তু সকল ক্ষমতার উৎস হলেন ওই ‘ একজন ’! এক তার কারণেই আপনি জানতেন না আমরা এখানে এসে পড়ব। ”
– সেটা ঠিক। কিন্তু এখন আপনার কি হবে?
একটু মুচকি হাসলাম আমি। নীলসাধুর কথা মনে পড়েছে। বললাম,
“ সবকিছুর শুরু ও শেষ ইশ্বরের নামে! আমি ইশ্বরের নাম নিয়েই গুলি চালাচ্ছি … ”
কথাটা শেষ না করেই গুলি চালালাম। যেটা আশা করছিলাম সেটাই হল। ইশ্বরের নামের সাথেই শেষ হয়ে গেলো স্মৃতিশ্বরের সকল ক্ষমতা।
পরিশিষ্টঃ
আরিশাকে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরতেই দেখালাম আর্মির কমান্ডোরা ওয়ালিদকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। নদীতে ভেসে ওয়ালিদ চলে গিয়েছিল আরাকান আর্মির একটা ক্যাম্পে। যে ক্যাম্পের সন্ধান আজকেই পেয়েছে বাংলাদেশ আর্মি। মাত্র আধা ঘণ্টার যুদ্ধেই উদ্ধার করে ওয়ালিদকে। সবাই ধারণা করেছে এতদিন বুঝি ওয়ালিদ সেখানেই ছিল। আর অনূসুয়া উদ্ধারের ব্যাপারটা সবাইকে বলেছি, “ পবিত্র মোহনা থেকে তাকে উদ্ধার করেছি। সেখানে সে গিয়েছিল প্রার্থনার জন্য। ”
কথাটা কেউ অবিশ্বাস করেনি। অনেক প্রশ্ন ছিল মনে। কেনই বা স্মৃতির মৃত্যু আমার হাতেই হলো। সে এলোই বা কি করে? ওয়ালিদের প্রতি কেন তার এত ভালোবাসা ছিল। কেন আরিশারই সাথে তার লড়াই হল। কেন এতদিন কেউ তাকে মারতে পারল না আর কেন সবখানে আমিই কেবল একমাত্র সাক্ষী হলাম!
প্রশ্নেগুলোর জবাব চাইছিলাম নীলসাধুর কাছে। কোন উত্তরই দেননি। মুচকি হেসে কেবল বলেছেন “ সব রহস্যের সমাধান হয় না, কমান্ডার! কিছু রহস্য অসমাধিতই থেকে যায়। ”
আরাকান আর্মি দমন, আরিশা ও মেজর ওয়ালিদের উদ্ধার এবং সবশেষে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাকে হারিয়ে দেওয়া … নিজের উপর দেওয়া কর্তব্যগুলো পালন করতে পেরে আমি সন্তুষ্ট।
কিছু রহস্য না হয় অসমাধিতই থাক!
… সমাপ্ত …
অনূসুয়া- অ্যান আনসলভড মিস্ট্রি (৪)
অনূসুয়া- অ্যান আনসলভড মিস্ট্রি (৩)
অনূসুয়া- অ্যান আনসলভড মিস্ট্রি (২)
অনূসুয়া- অ্যান আনসলভড মিস্ট্রি (১)
১৫টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
ইস শেষ!
“শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।” কারণ কিছু রহস্য রাখতেই হয়। তা নইলে কি করে হয়?
আপনি কি জানেন কি দারুণভাবে ধারাবাহিক এই লেখাটিকে উপস্থাপন করেছেন!
(y) -{@
শেষের অপেক্ষা ফুরিয়ে গেলে অনেক খারাপ লাগে, তা জেনেও শেষ জানার ইচ্ছে শুরু থেকে শুরু হয়।
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
সত্যিকার অর্থে ধারাবাহিক লেখাগুলো উপস্থাপন করা কিছুটা জটিল হয়। প্রতিটা পর্বে পাঠকের মনযোগ ধরে রাখার জন্য আলাদা করে কিছু করতে হয় এবং পর্বের শেষে এমন কিছু করতে হয় যাতে পরবর্তী পর্ব পাঠক আগের চেয়ে বেশি আগ্রহ নিয়ে পড়ে।
প্রত্যেক লেখকের জন্যই ব্যাপারটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আমি নিজেও সন্দিহান কতটুকু সফল হয়েছি সেটা নিয়ে। তবে আপনি শুরু থেকেই পাশে ছিলেন সেজন্য কৃতজ্ঞতা -{@
“ শেষের অপেক্ষা ফুরিয়ে গেলে অনেক খারাপ লাগে, তা জেনেও শেষ জানার ইচ্ছে শুরু থেকে শুরু হয় ” কথাটা আমার কাছে খুবই দারুণ লেগেছে 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
অবশ্যই ভালো লিখেছেন। আমি আবার তেল দিতে জানিনা। খারাপ লাগলে বলে দেই।
আর ওই কথাটি আমারই একটি লেখার থেকে তুলে দিয়েছি।
তবে আরো চাই, লিখুন। 🙂
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
সেটা কিছু পোস্টে আপনার মন্তব্য দেখেই বুঝে গেছি 😀
আর আপনার লেখা বরাবরই ভালো হয় -{@
মোঃ মজিবর রহমান
দারুন!
নীলাদি র মত আকাংখা থেকেই গেল
থাক লেখকরা তৃপ্তিতে থাক পাঠককে এভাবে রেখেই !!!!
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
ধন্যবাদ 🙂
পাঠকের যদি আকাঙ্খাই না থাকলো তাহলে লেখার স্বার্থকতা কতটুকু!
মোঃ মজিবর রহমান
হুম! ভাল লাগলো। -{@
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
আবারও ধন্যবাদ 🙂
অরুনি মায়া
সুন্দর একটা গল্প দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল |
অনেক ভাল লেখেন আপনি | তবে শেষ টায় একটু তাড়াহুড়ো মনে হয়েছে | অন্যথায় সুন্দর গল্প 🙂
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
গল্পটা একটা নির্দিষ্ট পরিসরে শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, সেজন্য শেষ দিকে একটু তাড়াহুরো করতে হয়েছে। 🙁
ভোরের শিশির
ব্যক্তিগত কারণে অনিয়মিত কিন্তু পোস্ট দেওয়ার সাথে সাথেই পড়েছি।
অন্য পর্বগুলোর মতো এই পর্ব অতোটা মিস্ট্রি ছিলো না… শেষতা যেভাবে হবে আশা করেছিলাম তা হয়তো পূরণ করতে পারেনি। তবুও প্রিয়তে নিচ্ছি।
বেশ ভাল একটা গল্প।
শুভেচ্ছা ফ্রাঙ্কো ভাই। -{@
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
শেষ পর্বে আসলে হটাৎ করেই শেষ হয়ে গেছে ;?
এটা লেখকের অদক্ষতা আর অপরিপক্বতার ফল ^:^
ভোরের শিশির
তবে গল্পটা বেশ ভালই ছিল 😀
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
আপনাকেও ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা -{@ 🙂
ভোরের শিশির
😀
-{@