সবে চাকুরি পেল অনিমেষ।নতুন চাকুরির সংবাদে পাড়া-মহল্লায় হুলস্থুল কান্ড ঘটে গেল!ছানাবড়া চোখ করে থাকা পাড়ার তথাকথিত মুরুব্বি,বড় ভাই,দাদাদের এই আশ্চর্যান্বিত অবস্থা বেশ অদেখা আনন্দের খোরাক যোগায় অনিমেষের মাঝে।অনিমেষও কিনা চাকুরি পেয়ে গেল এই কঠিন চাকুরি বাজারের প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির গোলকধাঁধায়।যাকে দিয়ে কিছুই হবে না বলে শত,সহস্র গঞ্জনা,অবজ্ঞা তরুহীন বৃক্ষের মত মাথা পেতে নিতে হয়েছিল তার ভাইকে,তাকে জুড়েই কিনা আজ পুরো পাড়া-মহল্লায় এত বন্দনা,এত গুঞ্জন,এত বাকা চোখের চাহুনি।
কে এই স্বপ্নকথার অনিমেষ?কেন তাকে নিয়ে এত কথা?
তবে কিছুটা পেছনে ফিরেই গল্পের নায়ক অনিমেষের জীবন তমসা অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা করা যাক সাথে থাকা গল্প কথকের ভাঙাচোরা হারিকেনের আলোয় ভর করে।
অনিমেষ যে কিনা অনু নামেই পরিচিত ছিল।বাবা অকালে মারা যাওয়ায় কোলে পিঠে মানুষ করার দ্বায়িত্বটা যে তারই সহোদর অগ্রজ শুভাশিসের উপর বর্তাল।
বাবার রেখে যাওয়া মুদির দোকানের গদিতে বসে স্টিয়ারিং উইলের ঘানি ধরতে হল শুভাশিসকেই।দুই ভাইয়ের বয়সের হেরফের ৬ এর কম নয়।আর যাই হোক অনুকে মানুষের মত মানুষ বানানোর এক অদম্য জেদ চেপে বসল শুভাশিসের মাঝে।
স্কুল ব্যাগ কেনা,নতুন নতুন বই কেনা,টিউটর নিযুক্ত করা,কাপড় চোপড়ের সংস্থান যাবতীয় সব কিছুতেই অন্ত রাখেনি শুভাশিস।চোখ বন্ধ করে যে স্বপ্ন সে দেখে,চোখ খোলে সেই স্বপ্নকেই আলিঙ্গন করতে চায় শুভাশিস অনুর মধ্য দিয়ে।
কিন্ত হঠাৎ অনুর যেন কি হল? পড়াশোনা কিংবা পরিবারের কারো সাথেই তেমন সম্পৃক্ততা রাখছে না অনু।ঠোটে ধোয়া ধোয়া ছাই রঙ আর স্বাস্থ্যের ক্রমাগত অবনতি বুঝতে পারে মা,শুভাশিস দুজনেই।
শুভাশিস ভবিষ্যতের জলছবি একে যায়,আর অনু সেটা পাশ কাটিয়ে যায়।সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি সে কালো আড্ডায় মশগুল থাকে।স্কুলে যাওয়ার ইতিরেখা বিপদগামী হয়ে সে নিজেই টানতে লাগল।
বকাটে,লম্পট ছেলেদের সাথে তাকে ভিড়িয়ে দিয়ে পাড়া প্রতিবেশীরা পৈশাচিক আনন্দ নেয়ার জোয়ারে ভাসছিল।এটি অজানাই ছিল শুভাশিসের।হঠাৎ তার এক কাজিনের মাধ্যমে সে এই অজানা সত্য জানতে পেরেছিল।
তদুপরি পাড়ার তথাকথিত পোড়া সমাজের একাংশ যখন অনুকে কারো দোকানে ঢুকানোর অযাচিত উপদেশ নিয়ে আসে,শুভাশিসের তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে কারা তার মেধাবী ভাইকে বখাটেদের খাতায় নাম লিখিয়েছিল।
ব্যাবসায় বেশ খরা যাচ্ছিল।মূলধনের সংকটে যখন নাভিশ্বাস,তখন খরচ আরো বাড়তে লাগছিল উচ্ছন্নে যাওয়া অনুর খরচার সংস্থানে।খরচাটা যদি স্বপ্ন পূরনের ভোগে লাগত দুঃখ ছিল না,খরচটা যে বেড়ে গেল জীবনকে শ্মশান বানানোর কারনে সেটাই কষ্ট।এই কথা বলেই মাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগল শুভাশিস।
দোকান ভিটার মালিক হঠাৎ দোকান ছাড়ার কথা বলল শুভাশিসকে এক মাসের নোটিশে।মাথায় যেন বাজ পড়ল হঠাৎ দোকান ছাড়ার এই অলঙ্ঘনীয় নির্দেশে।কি আর করা অগত্যা দোকানও ছাড়তে হল তাকে।কিন্ত বিধি বাম! এর ভিতরে কোন দোকান তার সীমার পরিধি সমকক্ষ করে বের করতে পারল না।
জীবন যখন জীবিকার মাধ্যমে বেচে থাকার প্রয়াস করে,শুভাশিসও বাবার অবর্তমানে মা আর অনুকে নিয়ে মাসিক বেতনে জৈনক ব্যক্তির দোকানে ঢুকে বেচে থাকার খড়কুটো ধরে।
অনুর কি জানি কি হল ফের! আছমকা ভাইয়ের এই হাড়ভাঙ্গা কষ্টের সাগরে ডুব দিতে লাগল।তার ভাইয়ের রাঙা স্বপ্ন,দোকান হারানো,আর্থিক মন্দাদশা তার মাঝে নবজাগরণ সৃষ্টি করল।
যে বেগে সে নষ্ট হচ্ছিল,তার দ্বিগুণ বেগে ঘুরে দাড়াতে লাগল।তার ভাইয়ের স্বপ্ন তাকে ঘুমেও জাগিয়ে রাখে।
পাড়া-মহল্লার কতিপয় মানুষের হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড তাকে নিরাশ না করে বরংচ এগিয়ে যাওয়ার মুষ্টিবদ্ধ দৃঢ়তা দিতে থাকে।
রাতজাগা কষ্ট আর গগনচুম্বি প্রত্যাশার সেতুপথ ধরে জীবন নদীর দুঃখের পাড় ছেড়ে সুখের পাড়ে আজ আবার (অনু) অনিমেষ।পাড়ার কুচক্রী মহলও যখন তাকে মাল্যদানের জন্য এগিয়ে আসে,অনিমেষ সেই মাল্য সগর্বে,সহাস্যে,সানন্দে তার ভাই শুভাশিসের গলে পড়িয়ে দেয়।আজ থেকে অনিমেষ সরকারি চাকুরিজীবি।নিজের ব্যাপারে মিতব্যয়ী আর আদরের ভাইয়ের ব্যাপারে সীমাহীন অমিতব্যয়ী শুভাশিসের আনন্দ যে কোন কৌটাতেই ধরে রাখার নয়।আর তার রেশ ধরেই কাছে,দূরে সবাইকে মিষ্টিমুখ করায় শুভাশিস।আর এভাবেই স্বপ্নযাত্রায় বড় ভাইয়ের মুখ উজ্জ্বল করে অনিমেষ তথাকথিত পোড়া সমাজকে নতুন এক অভিজ্ঞতা সঞ্চারে সহযোগিতা করে।
২০টি মন্তব্য
সুপায়ন বড়ুয়া
“সরকারী চাকুরী জীবি অনিমেষ স্বপ্নযাত্রায় বড় ভাইয়ের মুখ উজ্জ্বল করে তথাকথিত পোড়া সমাজকে নতুন এক অভিজ্ঞতা সঞ্চারে সহযোগিতা করে। “
এটাই বাস্তবতা তা তুলে আনলেন সুনিপুন ভাবে।
শুভ কামনা।
পার্থ সারথি পোদ্দার
হ্যা,দাদা। তৃনমুল এলাকার সমাজ বাস্তবতাটাই তুলে ধরার প্রয়াস করেছি।ধন্যবাদ পাঠ করার জন্য।
জিসান শা ইকরাম
পোড়া সমাজ কাউকে সামনে এগোতে দেয়না,
নস্ট করতে পারে সবাইকে।
বড় ভাইয়ের কস্ট দেখে এবং সমাজের প্রকৃতি বুঝতে পেরে যে অনিমেষ আবার ফিরতে পেরেছে নিজের আসল ধারায়, এটি আনন্দের।
অনিমেষরা এভাবে এগিয়ে যাক সামনে।
ভালো লেগেছে আশাজাগানিয়া গল্প।
শুভ কামনা।
পার্থ সারথি পোদ্দার
সুশ্রী মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ।এই অভিপ্রেত বার্তাটিই গল্পের মধ্য দিয়ে দিতে চেয়েছি।
শুভ কামনা আপনার প্রতিও।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ইকরাম দাদা ভাইয়ের সাথে আমি ও পুরোপুরি একমত। সমাজ, আত্নীয় স্বজন এভাবেই পিছনে টেনে ধরে, সামনে এগোতে দেয়না । কেউ কেউ এই বাধাকে জয় করতে পারে, কেউ আবার ডুবে যায় অতল গহ্বরে। অনিমেষ যে জয়ী হলো তা তার অদম্য ইচ্ছা, সাহস আর ঈশ্বরের কৃপায়। শেষটা দারুন ভাবে সমাপ্ত করলেন। ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন
পার্থ সারথি পোদ্দার
যথার্থই বলেছেন।আমরা বন্ধুভাবাপন্ন সমাজ যেন সমাজের সর্বাবস্থায় দেখতে পারি,সেটিই কামনা করি।
ধন্যবাদ পাঠ করার জন্য।
ফয়জুল মহী
পরিপাটি লেখা । ভালোবাসা ও শুভ কামনা।
পার্থ সারথি পোদ্দার
ভালবাসা নিরন্তর।ধন্যবাদ পাঠের জন্য কিছুটা সময় বের করার জন্য।আপনার প্রতিও রইল শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
খুব সুন্দর লেখা।
পার্থ সারথি পোদ্দার
ধন্যবাদ আপনাকে।
প্রদীপ চক্রবর্তী
সমাজের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে এ গল্পে।
ভালো লাগলো দাদা।
পার্থ সারথি পোদ্দার
ধন্যবাদ দাদা পাঠ করার জন্য।শুভ কামনা রইল।
আরজু মুক্তা
বাস্তব চিত্র। ভালো লাগলো। সবাই এমনটি বুঝলেই হয়।
পার্থ সারথি পোদ্দার
হুম,ঠিক বলেছেন।সকল লেখকদের গঠনমূলক লিখনী হোক সমাজ পরিবর্তনের হাতিহার।
হালিম নজরুল
সামাজিক অসংগতি আমাদের চলার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
পার্থ সারথি পোদ্দার
সমাজের ছোট বড় অসংগতিই কণ্টকময় পথ তৈরি করে দেয়।ঠিক বলেছেন,ভাই।ধন্যবাদ।
তৌহিদ
আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বিমুখী আচরণ অনেকাংশেই এর জন্য দায়ী।
ভালো থাকুন।
পার্থ সারথি পোদ্দার
একদম সঠিক কথা বলেছেন,ভাই।এই দ্বিমুখী আচরন স্বপ্নকে কোনঠাসা করে দেয়।
সঞ্জয় মালাকার
আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।
সবাই যদি এরকম বুঝতো তা হলে তো ভালোই হয়।
পার্থ সারথি পোদ্দার
মানসিকতা পাল্টানোই যে এখন বড় দায়।আধিপত্য রাখতে চায় প্রভাবশালীরা সর্বাবস্থায়।ধন্যবাদ,দাদা