অনন্য সুভাষ (৪)

সাতকাহন ৯ ডিসেম্বর ২০১৪, মঙ্গলবার, ০৪:০৫:৫১অপরাহ্ন সাহিত্য ৯ মন্তব্য

জেলে থাকাকালে ১৯২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৯ তারিখে সুভাষ বসু’র একটি নিবন্ধ ছাপা হয় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’তে, এই নিবন্ধে সুভাষ জোড়ালো কণ্ঠে বলে উঠেন, ভারতের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার কথা:

‘যে জাতির অস্তিত্বের আর সার্থকতা নেই, যে জাতির প্রাণের স্পন্দন একেবারে নিঃশ্বেষ হয়েছে সে জাতি ধরাপৃষ্ঠ থেকে লোপ পায়। অথবা কীটপতঙ্গের মতো কোনো প্রকারে জীবন ধারণ করতে থাকে।

ভারতের একটি বাণী আছে যেটা জগৎসভায় শোনাতে হবে। ভারতের শিক্ষার মাঝে এমন কিছু আছে যা বিশ্বমানবের পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় এবং যা গ্রহণ না করলে বিশ্ব সভ্যতার প্রকৃত উন্মেষ ঘটবে না। শুধু তাই না, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য, ব্যবসা-বাণিজ্য এসব ক্ষেত্রেও আমাদের জাতি এই জগৎকে কিছু দেবে, কিছু শিখাবে।

দেশান্তরে কারাবাসে মাসের পর মাস যখন কাটিয়েছি তখন প্রায়ই এ প্রশ্ন আমার মনে উঠতো কিসের জন্য, কিসের উদ্দীপনায় আমরা কারাবাসের চাপে ভগ্নপৃষ্ঠ না হয়ে আরো শক্তিমাণ হয়ে উঠছি। নিজের অন্তরে যে উত্তর পেতাম তার মর্ম এই যে, ভারতের একটা মিশন আছে, একটা গৌরবময় ভবিষ্যত আছে। সেই ভবিষ্যত ভারতের উত্তরাধিকারী আমরাই। নতুন ভারতের মুক্তির ইতিহাস আমরাই রচনা করছি এবং করবো। এই শ্রদ্ধা এই আত্মবিশ্বাস যার আছে, সেই ব্যক্তি সৃষ্টিক্ষম, সেই ব্যক্তি দেশসেবার অধিকারী।

অনেকে মনে করেন যে, দুঃখের মধ্যে বুঝি শুধুই কষ্ট আছে, কিন্তু এই কথা সত্য নয়। দুঃখের মধ্যে যেমন কষ্ট আছে, তেমনি দুঃখের মধ্যেও আছে অপার আনন্দ।

নীলকণ্ঠকে আদর্শ করে যে ব্যক্তি বলতে পারে আমার মধ্যে আনন্দের উৎস খুলে গেছে, তাই আমি সংসারের সকল দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা-ক্লেশ মাথায় তুলে নিচ্ছি, কারণ এর ভেতর দিয়ে আমি সত্যের সন্ধান পেয়েছি, সেই ব্যক্তির সাধনাই সিদ্ধ হইয়াছে।’[৯]

১৯২৭ সালে মান্দালয় জেল থেকে লিফলেট আকারে সুভাষের আরেকটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে সুভাষ লেখেন:

‘নিজের জীবন পূর্ণরূপে বিকশিত করিয়া ভারত মাতার পদতলে অঞ্জলিস্বরূপ নিবেদন করিবো এবং আন্তরিক উৎসর্গের ভিতর দিয়ে পূর্ণতর জীবন লাভ করিবো, এই আদর্শের দ্বারা আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।

আমার এই ক্ষুদ্র অথচ ঘটনাবহূল জীবনে যে সকল ঝড় আমার উপর দিয়া বহিয়া গিয়াছে, বিঘ্ন বিপদের সেই কষ্টিপাথর দ্বারা আমি নিজেকে সূক্ষ্মভাবে চিনিবার ও বুঝিবার সুযোগ পাইয়াছি।

এই নিবিড় পরিচয়ের ফলে আমার প্রত্যয় জন্মিয়াছে যে, যৌবনের প্রভাবে যে কণ্টকময় পথে আমি জীবনের যাত্রা শুরু করিয়াছি, সেই পথে শেষ পর্যন্ত চলিতে পারিবো। অজানা ভবিষ্যতকে সম্মুখে রাখিয়া যে ব্রত একদিন গ্রহণ করিয়াছিলাম তাহা উদযাপন না করিয়া বিরত হইবো না।

আমার সমস্ত প্রাণ ও সারা জীবনের শিক্ষা নিংড়াইয়া আমি সত্য পাইয়াছি, পরাধীন জাতির শিক্ষা-দীক্ষা-কর্ম সকলই ব্যর্থ; যদি তাহা স্বাধীনতা লাভের সহায় বা অনুকূল না হয়। তাই আজ আমার হৃদয়ের অন্তরতম প্রদেশ হইতে এই বাণী নিরন্তর আমার কানে ধ্বনিত হইয়া উঠিতেছে, ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে কে বাঁচিতে চায়?’[১০]

এইসময় মান্দালয় জেলে থাকাকালে আটককৃত বিপ্লবীদের সাথে সুভাষের সম্পর্ক ঘনিষ্ট থেকে ঘনিষ্টতর হয়। ১৯২৫ সালের ১৬ জুন তাঁর রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মারা যান। এই বিয়োগান্তক ঘটনায় সুভাষ ভেঙে পড়েন।

জেলে থাকাকালেই ১৯২৬ সালে সুভাষ বেঙ্গল এসেমব্লিতে সদস্য নির্বাচিত হন।  ১৯২৭ সালের মে মাস পর্যন্ত সুভাষ মান্দালয় জেলে বন্দি ছিলেন।

জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে তিনি যুব সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতৃত্বে আসেন এবং ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে তিনি অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন থেকেই বাঙলায় কংগ্রেস রাজনীতিতে দুটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়, একটি জে এম সেনগুপ্তের, অন্যটি সুভাষ বসুর। একই সাথে সর্বভারতীয় কংগ্রেসেও সুভাষের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় স্বয়ং গান্ধীর থেকেও বেশি। সেই সাথে সুভাষ যুব সম্প্রদায়ের প্রাণের নেতায় পরিণত হন।

সুভাষ সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধারণ জনতা তাঁকে সংবর্ধনা দিতে থাকেন। এইসব সংবর্ধনা সভায় সুভাষ যুব সম্প্রদায়কে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আহ্বান জানান। ১৯২৮ সালের ১ মার্চ অ্যালবার্ট হলে ছাত্রদের দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সুভাষ বলেন:

‘বলা বাহুল্য, স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতবর্ষে যুবকদের সাথে আমি একমত। দেশে যারা আশার পাত্র তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত যে কোন আন্দোলনে আমি তাদের চরণে নিজের জীবন দেবো। তরুণদের উপর আমার আস্থা আছে। আমি সুনিশ্চিত যে এই অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে সাফল্যে সঙ্গে তারা উত্তীর্ণ হবেন।’[১১]

১৯২৮ সালের ২ মার্চ মহীশুর পার্ক প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সভায় আগত নারীদের উদ্দেশ্যে সুভাষ জোড় গলায় বলেন, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কথা:

‘ভারতবর্ষ একসময় জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, বস্ত্র, জ্বালানী, লবণ, তেল উৎপাদনে গৌরবজনক অবস্থানে ছিলো। তখন নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা যেতো। এমনকি একশ’ বছর আগেও আমাদের সমৃদ্ধ বস্ত্রশিল্প ছিলো।

আমি মায়েদের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি যে, আপনারা ব্রিটিশ পণ্য স্পর্শ করবেন না, এই দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে আরো একবার প্রমাণ করুন যে হাত শিশুর দোলনায় দোল দিয়েছে সেই হাতই বিশ্ব শাসন করতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, স্বদেশির শপথ আপনারা যদি রক্ষা করেন তাহলে স্বাধীনতা লাভ করতে দেরি হবে না।’[১২]

১৯২৮ সালের ৪ মার্চ, বাকুড়ায় স্থানীয় নারীদের একটি বিশাল সমাবেশে সুভাষ বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে উঠেন ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের কথা, স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের বলিষ্ঠ ভূমিকার কথাও বলেন সুভাষ:

‘আমরা বিদেশিদের শোষণের অসহায় শিকার। যদি পৃথিবীর বুক থেকে ভারতীয় জাতিকে বিলুপ্ত হতে না হয়, তাহলে এই অবস্থার অবসান ঘটাতেই হবে। এই রকম জায়গায় নতুনদের কোনোরকম আত্মত্যাগ করতে কুণ্ঠিত হলে চলবে না। এমন কি, লক্ষ্যবস্তুর অনুসরণ করতে গিয়ে যদি আত্মবিলুপ্তি ঘটে তাও স্বীকার করে নিতে হবে।

আমি আপনাদের কাছে বিদেশি বস্ত্র বয়কটের জন্য আকুল আবেদন জানাচ্ছি। মহিলারা যদি আন্তরিকভাবে বয়কট আন্দোলনের ভারবহন না করেন তাহলে এই আন্দোলনকে সফল করে তোলার পক্ষে যাদের যোগ্যতা সর্বাধিক তাদেরই সমর্থনের অভাবে আমাদের সকল প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যাবে। আপন সংসারে বাঙালি নারী মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত। তাকে অমান্য করে এমন পুরুষ কোথায়…?’[১৩]

১৯২৮ সালের ৫ মার্চ, বাকুড়ায় পৌরসভা, জেলাবোর্ড ও নাগরিক কমিটি আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত সকলকে ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করতে বলেন সুভাষ। একই দিনে বাকুড়ার অভয় আশ্রমে এক সংবর্ধনা সভায় যুবকদের শারীরিক ও মানসিক গঠন এবং দেশপ্রেমে সিক্ত হওয়ার আহ্বান জানান।

তথ্যপঞ্জি:

৯.    আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৬
১০.  সুভাষের লিফলেট, মান্দালয় জেল ১৯২৭
১১.  আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ মার্চ ১৯২৮
১২.  আমি সুভাষ বলছি, শ্রী শৈলেশ দে, দে’জ পাবলিশার্স; কোলকাতা ১৯৭৩
১৩.  আমি সুভাষ বলছি, শ্রী শৈলেশ দে, দে’জ পাবলিশার্স; কোলকাতা ১৯৭৩

(…………………………………………………………চলবে)

আগের পর্বগুলোর লিংক:

অনন্য সুভাষ (১) http://sonelablog.com/archives/24619

অনন্য সুভাষ (২) http://sonelablog.com/archives/24727

অনন্য সুভাষ (৩) http://sonelablog.com/archives/24827

১জন ১জন
0 Shares

৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ