সুভাষ বসুর জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি তাঁর বাবার কর্মস্থল উড়িষ্যার কটক শহরে। বাবা জানকীনাথ বসু, মা প্রভাবতী দেবী। সুভাষ বসু ছিলেন বাবা-মায়ের নবম সন্তান। সুভাষদের পৈতৃক নিবাস পশ্চিম বাঙলার চব্বিশ পরগণার চাংড়িপোতা গ্রামে। সুভাষ পূর্ব-পুরুষের দিক দিয়ে দুইটি ভূস্বামী গোষ্ঠীর উত্তরসূরী ছিলেন, পৈতৃকসূত্রে মাহিনগরের বসু পরিবারের আর মায়ের দিক দিয়ে হাটখোলার দত্ত পরিবারের। সুভাষের বাবা জানকীনাথ বসু ছিলেন পেশায় একজন আইনজীবী, তিনি কটক শহরের স্বনামধন্য আইনজীবী ছিলেন। আর বাবা জানকীনাথ বসুর আইন ব্যবসার সূত্রেই সুভাষদের বসতি উড়িষ্যার কটক শহরে।
অন্যদিকে সুভাষের বাবা এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে, তিনি ১৯০১ সালে কটক শহরের প্রথম নির্বাচিত মেয়র। জানকীনাথ বসু ১৯০৫ সালে কটক শহরের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নিযুক্ত হন, কিন্তু ওই সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে বিবাদ সৃষ্টির কারণে ১৯১৭ সালে জানকীনাথ বসু পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯১২ সালে জানকীনাথ বসু বেঙ্গল লেজিজলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ওই সময়ই ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রায় বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করে। সুভাষের আইসিএস থেকে পদত্যাগে তিনি খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন, তবে পরবর্তীকালে সুভাষের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি খুবই গৌরববোধ করেছিলেন সুভাষের মতো সন্তানের পিতা হতে পেরে। ভারতের স্বাধীনতার দাবিতে ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া রায় বাহাদুর খেতাব বর্জন করেন জানকীনাথ বসু।
সুভাষের বাল্যশিক্ষা শুরু হয় কটক শহরের র্যাভেন’শ কলেজিয়েট স্কুলে। প্রধান শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী বেণীমাধব দাস। বেণীমাধব ছিলেন দেশপ্রেমিক এবং আদর্শবান একজন শিক্ষক। ছাত্রদের দেশপ্রেমিক ও আদর্শ চরিত্র গঠন এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধকরণে বিপ্লবী বেণীমাধব দাসের অবদান ছিলো অপরিসীম। সুভাষ বসুর জীবনে মূলত এই বিপ্লবীর প্রচ্ছন্ন ছায়া শেষদিন পর্যন্ত ছিলো।
সুভাষ ১৯১১ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে ওটেন সাহেব নামে একজন ইংরেজ অধ্যাপক ভারত বিরোধীতায় মুখর হয়ে উঠতেন শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের সময়। এই কারণে ওটেন সাহেব বিপ্লবী অনঙ্গমোহন, বিপ্লবী সতীশ দে ও সুভাষ বসুর দ্বারা প্রহৃত হন। এই অপরাধে ১৯১৬ সালে অন্যদের সাথে সুভাষ বসুকেও কলেজ থেকে বহিস্কার করা হয়।
এরপর কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে কাটানোর পর ১৯১৭ সালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহায়তায় সুভাষ স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯১৯ সালে দর্শন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীতে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই সময় সুভাষ ইউনির্ভাসিটি অফিসার্স কোর-এ যোগ দিয়ে সমরবিদ্যায় জ্ঞান অর্জন করেন।
বাবা জানকীনাথ বসু ও পরিবারের সিদ্ধান্তে আইসিএস পড়ায় মনস্থির করলেন সুভাষ। ১৯১৯ সালের শেষের দিকে আইসিএস পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে যান সুভাষ। মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই চতুর্থস্থান অর্জন করে আইসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সুভাষ। ১৯২১ সালে ক্যামব্রিজ থেকে গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করেন সুভাষ।
সুভাষের বাল্যকাল ও কৈশোর কেটেছে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের উত্তপ্ত পরিবেশে। এই আন্দোলন সারা ভারতবর্ষেও রাজনৈতিক অঙ্গন প্রকম্পিত করে তুলেছিলো। স্কুলে যখন পড়তেন তখন সুভাষ বিপ্লবী গুরু অরবিন্দ ঘোষকে দেখেছিলেন বিপ্লবী প্রচেষ্টায় অক্লান্ত পরিশ্রম করতে। দেখেছিলেন প্রফুল্ল চাকী ও প্রফুল্ল চক্রবর্তীর আত্মাহুতি; ক্ষুদিরাম বসু, কানাই লাল দত্ত, সত্যেন বসু, চারু বসু, বীরেন দত্তগুপ্তকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে দেখেছেন। কলেজে পড়াকালী সময়ে দেখেছেন প্রখ্যাত বিপ্লবী নেতা রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে দিল্লীতে লর্ড হার্ডিঞ্জ-এর উপর বোমা নিক্ষেপ করতে, সেই রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বেই দেখেছেন ভারতবর্ষে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ সংঘটিত করতে; দেখেছেন বিপ্লবী বাঘা যতীনকে তাঁর চার সহকর্মী চিত্তপ্রিয় চৌধুরী, নীরেন দাশগুপ্ত, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং যতীশ পালসহ ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে শহীদ হতে।
১৯১৯ সালে সুভাষ যখন আইসিএস পড়তে গেলেন ইংল্যান্ডে, তারপরই জালিওয়ালানবাগের পাশবিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। ১৩ এপ্রিলের ওই হত্যাকাণ্ডে দুই হাজারের বেশি নিরস্ত্র মানুষ হতাহত হয়েছিলো। সারা ভারতবর্ষ তখন প্রতিবাদে ও নিন্দায় সরব হয়ে উঠেছিলো, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাইট উপাধি বর্জন করেছিলেন ওই ঘটনার পরে। ওই ঘটনা প্রতিবাদী সুভাষকে প্রবলভাবে ব্যথিত করে তুলেছিলো। সেই সময় সারা ভারতবর্ষে যেভাবে ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি সুভাষ যে বিপ্লবের অগ্নিস্ফূলিঙ্গ প্রত্যক্ষ করেছেন তা তাঁর বিপ্লবী মনের উপর প্রচণ্ডভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তখন ভারতবর্ষে দেশাত্ববোধ ও জাতীয়তাবোধের যে উন্মেষ ঘটেছিলো তা তিনি অবলোকন করেছেন, উপলব্ধি ও আত্মস্থ করেছেন। ওই ঘটনাগুলোর মাধ্যমেই তিনি দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের সাথে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে ফেলেন; যা পরে তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের উপর প্রচণ্ডভাবে প্রভাব ফেলে। ইংল্যান্ডে থাকাকালে পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি সেখানকার সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানগুলো অবলোকন করেন এবং ইউরোপ সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। বিশেষ করে আয়ারল্যান্ডের জাতীয় আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেন।
(………………………………………………………………চলবে)
১৩টি মন্তব্য
মামুন
ভালোলাগল, জানতে পারলাম নতুন কিছু। ধন্যবাদ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ মামুন। সাথে থাকবেন।
ব্লগার সজীব
নেতাজী সুভাষ বসুর প্রতি আগ্রহ ছোট বেলা থেকেই। পড়লাম। আরো পড়তে চাই।
সাতকাহন
ধন্যবাদ সজীব। সাথে থাকবেন।
খেয়ালী মেয়ে
সুভাষ বসু সম্পর্কে অজানা এসব তথ্য শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ…
সাতকাহন
খেয়ালী মেয়ে, সাথে থাকবেন। সামনে আরো আছে।
শুন্য শুন্যালয়
সুভাষ বসু সম্পর্কে তেমনি কিছু জানা নেই। আপনার কারণে কিছু জানতে পারছি এজন্য অবশ্যই ধন্যবাদ। সাথে আছি ভাইয়া।
সাতকাহন
ধন্যবাদ শুন্য।
জিসান শা ইকরাম
নেতাজী বলতে এখনো সুভাষ বসুকে বুঝি।
লিখুন আরো ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ জিসান ভাই, এই লেখাটি অনেক বড়, সাথে থাকবেন।
রাতুল_শাহ
চলার মাঝে আবার বেশি বিরতি দিয়েন না ভাই,
সাতকাহন
না, বেশি বিরত নেবো না।