১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সরকার লন্ডনে ভারতের নেতাদের সাথে আলোচনার জন্য গোলটেবিল বৈঠক আহবান করে। কিন্তু গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধীজির যোগদানের ব্যাপারে সুভাষ আপত্তি করেন। সুভাষ বলেন:
‘এই বৈঠক ব্রিটিশদের একটা ভাওতা মাত্র; এর আসল উদ্দেশ্য হলো, ভারত যে স্বাধীনতা লাভের অনুপযুক্ত জোর গলায় সেই কথাই প্রমাণ করা। তাই আপনার এই বৈঠকে যোগ দেয়া উচিত নয়।’[৩৪]
গান্ধীজি সুভাষের কোনো যুক্তিই মানতে রাজি ছিলেন না। গান্ধীজির মনোভাব লক্ষ্য করে সুভাষ এরপর বলেন:
‘I will not stand in the way of Mahatma going to the Round Table Conference. Let him come back disillusioned. I will then stand vindicated.’[৩৫]
প্রবল বাধা সত্ত্বেও গান্ধীজি লন্ডনের গোলটেবিল বৈঠকে গেলেন, যা হবার তাই হলো। বৈঠক শেষে পাহাড় সমান ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নিয়ে গান্ধীজি ২৮ ডিসেম্বর ভারতে ফিরে এলেন।
শেষ চেষ্টা হিসেবে গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধীজি ব্রিটিশদের কাছে আবেদন করে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বরের নামে তোমাদের কাছে আবেদন করছি, এই দুর্বল বাষট্টি বছরের বৃদ্ধকে তোমরা শেষবারের মতো সুযোগ দাও। তোমাদের অন্তরের ক্ষুদ্র এক কোণে আমাকে আর আমার প্রতিষ্ঠানকে স্থান দাও।’ এই কথা বলেই তিনি থামেননি, সেই সঙ্গে তিনি সরাসরি ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যত কি সত্যি তোমরা দেখতে পাও না? আমার এই দাবী উপেক্ষিত হলে ইতিহাস তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবে না। আর সেই ইতিহাস লেখা হবে সন্ত্রাসবাদীদের রক্তের কালিতে লেখা।’[৩৬]
গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধীজি সেদিন ইংরেজদের কাছে ধরা দিয়েছিলেন, তা জওহরলাল নেহেরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এডওয়ার্ড টমসনের জওহরলাল নেহেরুকে লেখা এক চিঠিতে স্পষ্ট উঠে এসেছে; তিনি লিখেছিলেন, ‘গোলটেবিল বৈঠকের আগে গান্ধীজির কোনো ত্রুটি আমার নজরে পড়েনি। এবার পড়লো। গান্ধীজি শুধু অহংসর্বস্ব নন, অসংলগ্নও বটে। তিনি ইংল্যান্ডে না এলেই ভালো করতেন।’[৩৭]
এদিকে আরউইনের পরে বড়লাট নিযুক্ত হলেন লর্ড ওয়েলিংডন, তিনি এসে গান্ধী-আরউইন চুক্তি তো মানলেনই না, বরং কোনো প্রতিশ্রুতিই ব্রিটিশরা রক্ষা করলো না। দলে দলে নেতা-কর্মীদের জেলে ঢোকানো শুরু হলো। এই দেখে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ অবাক। তাদের কথা, ব্রিটিশরা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বিপ্লবীদের মুক্তি দেয়নি; ভগত সিং, সুখদেব ও রাজগুরুদের ফাঁসি দিয়েছে; হিজলী বন্দি নিবাসে গুলি করে নিরস্ত্র বন্দিদের হত্যা করেছে, গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধীজিকে ডেকে নিয়ে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে-এসব তারা মুখ বুজে সহ্য করেছে; কিন্তু চুক্তি ভঙ্গ করলো কি কারনে?
১৯৩২ সালের ১ জানুয়ারিতে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসলো বোম্বেতে, সেখানে প্রস্তাবে সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়ে বলা হলো, ‘এই সরকারের কাছ থেকে ৭ দিনের মধ্যে আমরা সঠিক উত্তর চাই। অন্যথায় আবার শুরু হবে আইন অমান্য আন্দোলন।’[৩৮] এই আল্টিমেটামের পর শুরু হলো গণগ্রেপ্তার। সুভাষ, গান্ধীজি, প্যাটেলসহ সকল কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। সুভাষকে নেয়া হলো মধ্যপ্রদেশের সিডনি সাবজেলে, তারপর জব্বলপুর সেন্ট্রাল জেলে। জব্বলপুর সেন্ট্রাল জেলের মধ্যেই সুভাষের স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি ঘটে, কাজেই তাঁকে নেয়া হয় ভাওয়ালী স্বাস্থ্য নিবাসে পরে লক্ষ্ণৌর পর বলরামপুর হাসপাতালে ও লক্ষ্ণৌর জেলে।
ভারতে তখন উন্নত চিকিৎসার ভালো ব্যবস্থা ছিলো না, তাই সুভাষকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ইউরোপে পাঠানো হবে, এই শর্তে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৩৩ সালের ২ মার্চ সুভাষ ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা করেন। যাওয়ার পূর্বে গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে দুটি পরিচয়পত্র চেয়েছিলেন ইউরোপের বরেণ্য রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশে, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে পরিচয়পত্র দিলেও গান্ধীজি দিলেন না পরিচয়পত্র, গান্ধীজি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন সুভাষকে কোনো পরিচয়পত্র দেয়া তার পক্ষে সম্ভব না।
তথ্যপঞ্জি:
৩৪. মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, রমেশচন্দ্র মজুমদার, আনন্দ পাবলিশার্স; কলকাতা ১৯৬৫
৩৫. মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, রমেশচন্দ্র মজুমদার, আনন্দ পাবলিশার্স; কলকাতা ১৯৬৫
৩৬. মৃত্যুঞ্জয়ী, তথ্য-সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার; ভারত, মার্চ ১৯৮২
৩৭. মৃত্যুঞ্জয়ী, তথ্য-সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার; ভারত, মার্চ ১৯৮২
৩৮. আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ জানুয়ারি ১৯৩২
পূর্বের পর্বগুলোর লিংক:
অনন্য সুভাষ (১) http://sonelablog.com/archives/24619
অনন্য সুভাষ (২) http://sonelablog.com/archives/24727
অনন্য সুভাষ (৩) http://sonelablog.com/archives/24827
অনন্য সুভাষ (৪) http://sonelablog.com/archives/24920
অনন্য সুভাষ (৫) http://sonelablog.com/archives/25039
অনন্য সুভাষ (৬) http://sonelablog.com/archives/25609
অনন্য সুভাষ (৭) http://sonelablog.com/archives/26083
অনন্য সুভাষ (৮) http://sonelablog.com/archives/34341
অনন্য সুভাষ (৯) http://sonelablog.com/archives/34537
৪টি মন্তব্য
ইমন
চলতে থাকুক ইতিহাস পাঠ । ভালো লাগছে পড়তে। খুব জরুরী আমাদের ভারতবর্সের এই ইতিহাস জানা। ধন্যবাদ আপনাকে -{@
সাতকাহন
ধন্যবাদ, ইমন।
নীলাঞ্জনা নীলা
আরোও জানার ইচ্ছে রইলো। লিখুন। 🙂
সাতকাহন
ধন্যবাদ আপু। অনেক বড় হবে এই সিরিজ, সম্ভবত ১০০ পর্ব হতে পারে।