অণুগল্পঃ কালো শার্ট

রাইসুল জজ্ ২২ মে ২০১৫, শুক্রবার, ১০:৪০:০৩পূর্বাহ্ন গল্প, বিবিধ ৩০ মন্তব্য

আমার একটা কালো শার্ট ছিলো । কলারটা ছাই রংয়ের । কালো শার্টের কলার কেন ছাই রংয়ের হলো এটা একটা বিরাট রহস্য । শার্টটা কেনার পর বাড়িতে এসেই আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করলাম, বলেন তো ব্রাদার কালো শার্টের কলার কেন ছাই রংয়ের ? উনি কোন উত্তর না দিয়ে আগের মতই জিভ বের করে থাকলেন । আমি আগেও খেয়াল করেছি এটা তার একটা ভং । যখন কোন কিছুর উত্তর দিতে পারে না তখন এমন ভেংচি কেটে ভং ধরে । সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই রহস্যের সমাধান আমি বের করবই । রহস্যের সমাধান বের হলেই আমার একটা স্বপ্ন পূরন হবে । অনেকগুলো গোপন স্বপ্ন আছে আমার । সবারই অবশ্য থাকে । আমারটা একটু ভিন্ন । আইনস্টাইন ব্যাটাকে একদিন দেখিয়ে দিতে চাই, তারচেয়ে আমি এক আঙ্গুলও কম না । আমিও চিন্তা করতে পারি । একেবারে ছোটখাট জিনিস নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ঝিম মেরে চিন্তা করতে ভালো লাগে । চিন্তা করতে করতে ঘুমাতে ভালো লাগে । ঘুমের ঘোরে চিন্তাগুলো সবথেকে ফ্রেশ হয় । টয়লেটে বসে চিন্তা করার থেকেও ত্রুটিমুক্ত চিন্তা করা যায় একমাত্র ঘুমের মাঝেই ।

চিন্তা করা ছাড়াও আমার আরেকটা প্রিয় কাজ আছে । মানুষ দেখা । আমার মানুষ দেখতে ভালো লাগে । যখন চিন্তা করার কিছু খুজে পাইনা তখন হেটে হেটে আমি মানুষ দেখি । প্রত্যেক্টা মানুষের চোখ নাক কপালে হাজার হাজার গল্প লেখা থাকে । সবাই সে লেখা পরতে পারে না । আমিও পারি না । তাই মানুষ দেখে গল্প বানাই । প্রতিটা মানুষের গল্প আলাদা আলাদা ভাবে একরকম হয়ে যায় । আমার বানানো গল্প গুলো কেন জানি অসমাপ্ত হয় । অনেকটা আমার জীবনের মত । প্রতিটা মানুষ এক একটি অসমাপ্ত গল্পের মাঝে বেড়ে ওঠে, প্রেম করে, দুঃখ পায়, তারপর মরে যায় । গল্পের শেষ হয় না । গল্পটা অসমাপ্ত থেকেই যায় । আমার অনেকদিনের ইচ্ছে, আমার সব গল্পগুলো একদিন সমাপ্ত হবে । পরিবাগের মোড়ে যে পাগলটা চিৎকার করে গালাগালি করে তার সাথে মিলে যাবে সিটি কলেজের নাম না জানা সেই মেয়েটার গল্প, যার চিবুকের নিচের কাটা দাগটা দেখে আমি তাকে জোবাইদা ডেকেছিলাম । একি সাথে মিলে যাবে আমাদের টুনির মায়ের গল্পটাও । টুনির মায়ের গর্ভে এখন কার সন্তান সেটাও হয়তো জানা যাবে একদিন । গল্পে টুনির একটা বিয়েও দিয়ে দেব । তার তিনটা বাচ্চা হবে, দুইটা ডোরাকাটা, একটা কালো । কালো বাচ্চাটার নাম দেব মিনি । মিনি কি আরেকটা নতুন গল্পের শুরু করবে ? জানি না । আমার জানতে ইচ্ছে করে না । গল্প বানাতে বানাতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি । এতোটা ক্লান্তি আমার উপর কবে থেকে ভর করেছে ? হয়তো প্রতিটা অসমাপ্ত গল্পের নায়ক নায়িকারা রোজ আমাকে অভিশাপ দেয় । এরকম হাজারো অভিশাপে আমি অভিশপ্ত হয়ে আছি অনেকদিন ধরে ।

আমি অবশ্য ঠিক জানি, অনেক দিন আগে আমি এমন অভিশপ্ত ছিলাম না । আমার স্পষ্ট মনে আছে, অনেকদিন খুব ভোরে একা একা হাটার সময় একটা পাখি আমাকে ডেকে বলেছিলো আমি একদিন অনেক বড় হবো । গাছের সমান । তখন আমার গাছ হওয়ার সাধ জেগেছিলো । আমি রোজ রোজ গাছেদের কাছে গিয়ে বলতাম, আমাকে নিয়ে নাও । আমি সব ছেড়ে তুমি হবো, তোমার হবো । ফলবতী গাছটা একটা পাখিকে ভালোবাসতো । হঠাত করেই তাই আমি পাখি হয়ে যেতে চেয়েছিলাম । কিন্তু পারি নি । পারিনি বলেই আমি অভিশপ্ত হলাম । কি অবাক ব্যাপার ? অভিশপ্ত হওয়ার পর আমি এখন সব হতে পারি । কখনো পাখি, কখনো গাছ । কিন্তু সেই পাখি আর সেই গাছটার কথা আমি দিব্যি ভুলে ছিলাম । একদিন হঠাত খবর পেলাম পাখিটাকে কোথাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না, গাছটাকে এখন একটা পিপড়া ভালোবাসে । পিপড়াটার বিশাল একটা দল আছে । আমি চুপচাপ সেই দলে ভিড়ে গিয়েছিলাম । পিপড়া জীবন আমার সুখের হয় নি । পিপড়া গুলো সারাদিন খাটে । চিন্তা করার সময় তাদের কই । তাই একদিন ফিরে এলাম । যেখান থেকে আমার অভিশপ্ত জীবনের শুরু ঠিক সেখানে । এখানে এখন অনেক মাছির বাস । মাছিরা আমকে বন্ধু বানিয়ে ফেললো । অথচ আমি অভিশপ্ত ছিলাম । তারা সারাক্ষন আমাকে গান শোনায় । গানের তালে তালে আমি ঝিমায় । ঝিমুতে ঝিমুতে চিন্তা করি । চিন্তা গুলো এখন অনেকটা স্বপ্নের মত মনে হয় । অভিশপ্ত হওয়ার আগে যেমন স্বপ্ন দেখতাম ঠিক সেরকম কিছু স্বপ্ন আমাকে রোজ খাইয়ে পড়িয়ে বাচিয়ে রাখে । মাঝে মাঝে স্বপ্নে সেই কালো শার্টটা আসে । আমাকে ডেকে বলে রহস্যের সমাধান করো । একদিন তোমাকে আইন্সটাইন হতে হবে । আমি ঝিমুনি ভাঙ্গার পর জেগে উঠে কালো শার্টটা খুজতে থাকি । কিছুদুরে মাছিরা আমার কালো শার্টটা ঘিরে নৃত্য করে । সেই শার্ট পড়ে কেউ একজন ঝুলে থাকে সিলিং্যের সাথে । কিছুদিন আগেও শার্টটা আমার ছিলো । মাত্র কিছুদিন আগে ঝুলে থাকা সেই লাশটাও আমি ছিলাম ।

৭২৩জন ৭২৩জন
0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ